প্রস্তাবিত তালিকায় নাম থাকা যাদেরকে নিয়ে বিতর্ক

হাসান শান্তনু

নির্বাচন কমিশন
ফাইল ছবি

অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) কাছে প্রস্তাবিত নামের তালিকায় থাকা কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। ঋণ খেলাপি, একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, মাদ্রাসাভিত্তিক অনুদানের টাকা আত্মসাতে জড়িত ও উগ্রপন্থি সংগঠন হেফাজতঘনিষ্ঠ মাওলানা হিসেবে অভিযুক্তরা আছেন তালিকায়। বিভিন্ন ‘রাজনৈতিক দল করা’, যাদের নিদির্ষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ, এমন অন্তত চার থেকে পাঁচজন আছেন। আছেন গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী কয়েকজন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রকাশিত তালিকা পর্যালোচনা, অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গতকাল সোমবার রাতে তালিকা প্রকাশের পর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়াচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করছেন অনেকে। তাদের নাম কারা, কেন প্রস্তাব করেছেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। তালিকায় এমন অন্তত অর্ধশতজনের নাম আছে, যাদের নিজ পেশায় পরিচিতি, খ্যাতি নেই। তাদের সম্পর্কে নেই দেশের মানুষের ধারণা, আস্থা। কয়েকজন আছেন তালিকায়, যারা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা, যোগ্যতা রাখেন কী না, এ প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, প্রকাশিত তালিকার অধিকাংশ নাম নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির। অনেকের নাম আছে, যারা তুলনামূলক সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য, সম্মানিত। তাদের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। দলনিরপেক্ষ হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া প্রকাশিত তালিকার বাইরে যে কাউকে চূড়ান্ত করতে পারে অনুসন্ধান কমিটি। এটা কমিটির সিদ্ধান্ত। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মত ও পথকে বলেন, ‘তালিকায় এমন অনেক ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত, যাদের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।’

যোগাযোগ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকার বাইরেও ইসি গঠনের জন্য প্রয়োজনে আরো নাম খুঁজতে পারবে সার্চ কমিটি।’ তালিকা প্রকাশের পর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুকে লেখেন, ‘৩২২ জনের নামের প্রস্তাব পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। বেশিরভাগই আজেবাজে নাম। এতো ফালতু নাম যারা দিয়েছেন, তাদেরও নাম প্রকাশ জরুরি। এসব লোক দিয়ে ভালো নির্বাচন চায় জাতি?’ সাংবাদিক জায়েদুল আহসান লেখেন, ‘আজেবাজে নামগুলো কারা দিল, সেটা জানা দরকার। দল, সংগঠন বা ব্যক্তির রুচিবোধটা জানা যেত!’

জানা যায়, বিএনপি-জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা এম নাজিম উদ্দিন আল আজাদ আছেন তালিকায়। সামরিক সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। ব্র্যাক ব্যাংকে ঋণখেলাপির কারণে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে যশোর-৪ আসনে বিকল্পধারা দল থেকে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে ইসি। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি বিএনপি ছেড়ে বিকল্পধারায় যোগ দেন, ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে তার মনোনয়ন পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লে। যশোর জেলা ছাত্রলীগের নব্বইয়ের দশকের ছাত্রনেতারা ২০২১ সালের ৯ আগস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন নাজিম উদ্দিন আল আজাদ।’

তালিকায় নাম আছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজে তার অনিয়ম, দুর্নীতির প্রমাণ পায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রংপুরে না গিয়ে ঢাকায় বসে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে বিতর্কে জড়ান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর হয়ে রংপুর বিমানে আসা-যাওয়া করে ক্লাস নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজের জন্য চাল-ডাল কেনা, নতুন শিক্ষকদের নির্ধারিত ড্রেস তার দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা, পছন্দমতো লোকজনকে নিয়োগ কমিটিতে রাখাসহ নানা অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। কে, বা কারা কমিটির কাছে তার নাম প্রস্তাব করেন, তা জানা যায়নি।

তালিকায় থাকা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ কাজী দীন মোহাম্মদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন গত সংসদ নির্বাচনে অওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান। চিঠি পেলেও বিএনপি দল হিসেবে সার্র্চ কমিটির কাছে ইসি গঠনে কারো নাম প্রস্তাব করেনি। দলটির শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পরিচিত ও সাবেক দলীয় নেতারা আছেন প্রস্তাবিত তালিকায়। অনেকের ধারণা, বিএনপিপন্থি নিবন্ধনহীন বিভিন্ন সংগঠন এসব নামের প্রস্তাব পাঠায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুটি দলের নামেই গজিয়ে উঠা নিবন্ধনহীন অনেক সংগঠন আছে।

প্রকাশিত তালিকায় তিনজন মাওলানার নাম আছে। তিনজনকে নিয়েই বিভিন্ন বিতর্ক আছে। তাদের একজন কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড আল হাইআতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান। তিনি হেফাজত ঘনিষ্ঠ ও সংগঠনটির মতাদর্শে বিশ্বাসী হিসেবে পরিচিত। ঢাকার যাত্রাবাড়ির যে মাদ্রাসার শীর্ষ দায়িত্বে তিনি আছেন, এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা গত বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেন।

গত বছরের ৩ মে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদ্রাসাভিত্তিক অনুদানের টাকা আত্মসাতে জড়িত হেফাজতের ৫৩ শীর্ষ নেতা ও ৩০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। মাহমুদুল হাসানের নামও আসে ওই পত্রিকাটির প্রতিবেদনে। তিনি ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে পরে যুগান্তরে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বা প্রকাশিত তথ্য প্রসঙ্গে কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠাননি। তার মেয়ের জামাতা যাত্রাবাড়ির জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস নেয়ামতুল্লাহ আল ফরিদী ২০১৯ সালে সরকারি খরচে হজ করে আলোচনায় আসেন।

তালিকায় থাকা চট্টগ্রাম সোবহানিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ কাযী মঈনুদ্দীন আশরাফী ‘হেফাজতের মতাদর্শ বিরোধি’। তিনি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নামে ধর্মপন্থি একটি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন। ওহাবিবাদে বিশ্বাসীদেরকে ‘কাফের (অবিশ্বাসী) বলে থাকে তার সংগঠন। এটাসহ ধর্মীয় আরো কিছু বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে সুন্নি-ওহাবির সংঘাত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

তালিকার আরেক মাওলানা ড. নজরুল ইসলাম আল মারুফ আগে বিএনপির ‘সমর্থক’ ছিলেন। এখন বিতর্কিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের’ (বিএনএফ) মহাসচিব তিনি। ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে গত ২৯ ডিসেম্বর বিএনএফের সংলাপ ছিল। এতে নজরুল ইসলাম অংশ নেন। রাষ্ট্রপতির কাছে দলটির প্রস্তাব ছিল ইসিতে ‘দুজন আলেম’ রাখতে। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা কাউকে কোনোভাবেই ইসিতে রাখার সিদ্ধান্ত সাধারণত নেওয়া হয় না।

তার নাম তালিকায় কে প্রস্তাব করেছেন, তা তিনি ‘জানেন’ না। তিনি ঢাকার দারুল উলুম হোসাইনিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পেতে যুগ্ম সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করে আলোচনার জন্ম দেওয়া আবুল কাশেমও আছেন তালিকায়। আছেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর স্ত্রী ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব রোকসানা কাদের। তার নাম প্রস্তাব করে জাপা।

অখ্যাত ব্যক্তিদের নামও আছে তালিকায়। তারা হলেন- কবি ফিরোজা আক্তার, মুঠোফােন রিচার্জ ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলু, ফ্রিল্যান্স পরামর্শক জ্যোতি বিকাশ বড়ূয়া, প্রবাসী মজিবর রহমান মজিব, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বরগুনার শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালিব মিয়া, ‘ট্যুরিজম স্কলার’ রাফিউজ্জামান, সম্পাদনা পরামর্শক মোহাম্মদ রাফিউজ্জামানসহ কয়েকজন।

শেয়ার করুন