‘অন্যের মাধ্যমে সার্চ কমিটিতে’ কি বিএনপি নাম প্রস্তাব করেছে?

হাসান শান্তনু

বিএনপি-ইসি

অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটির) কাছে বিএনপি ‘দলীয় একাধিক সংগঠন, দলটির সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের মাধ্যমে’ নাম প্রস্তাব করেছে বলে গুঞ্জন উঠছে। কমিটির কাছে আসা প্রস্তাবিত নামের তালিকা সোমবার রাতে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এমন গুঞ্জন ছড়ায়। তালিকায় ‘বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে পরিচিত অনেকের নাম থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে অনেকের এমন প্রশ্ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, সরাসরি নাম প্রস্তাব না করলেও বিএনপি সার্চ কমিটিতে ‘অন্যের মাধ্যমে’ নাম দিয়েছে। সত্যিই কি দলটি এমন রাজনৈতিক কৌশল করেছে?

মত ও পথের অনুসন্ধান বলছে, বিএনপির সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া আমলা, দলটির ‘শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পরিচিত’, সাবেক নেতা ও সুযোগ পেলে দলটিতে ফিরে যেতে আগ্রহীদের নাম আছে তালিকায়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ কমিটির কাছে বিএনপিপন্থি সাতটি সংগঠন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নাম প্রস্তাব করে। দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অন্তত পাঁচ নেতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে’ নাম প্রস্তাব করেন। যে কোনো রাজনৈতিক দল ‘পরিস্থিতি বিবেচনায়’ নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, বিএনপিপন্থি সংগঠনগুলোর নিবন্ধন না থাকলেও ‘দলীয় স্বীকৃতি’ আছে। দলটির স্থায়ী কমিটির কয়েক সদস্য সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এসব সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভায় তারা অংশ নেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নামেও গজিয়ে ওঠা এমন সংগঠন আছে। দলীয় নিবন্ধন না থাকা এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা অতিথি হন। পরবর্তী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য গঠিত সার্চ কমিটির কাছে প্রায় পাঁচটি রাজনৈতিক দল এমন অন্তত বিশজনের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাদের মধ্য থেকে একাধিক জনকে রাখা হলে সব রাজনৈতিক দলের কাছে নতুন ইসি গ্রহণযোগ্য হবে।

সার্চ কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আটজনের নাম প্রস্তাব করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর প্রস্তাবিতরা হলেন- সিইসি হিসেবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাবেক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভুঁইয়া, সাবেক সচিব শওকত আলি, সাবেক সচিব খালেদ শামস, মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ও সাবেক আইন সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল।

বিএনপির সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া সাবেক সচিব খালেদ শামসেরের বাবা শামসুল হক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন জিয়াউর রহমানের আমলে। হাবিবুল আউয়ালও বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী। আইন সচিব হিসেবে নিয়োগের সময় নীতিমালা অমান্য হওয়ায় তাঁর নিয়োগ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। সচিব থাকাকালে বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়ে বিতর্কে জড়ান তিনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এজন্য তলব করলে ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমা চান তিনি। তালিকার বাকি ছয়জনের প্রতি বিএনপি আস্থা রাখে বলে জানায় দলটির সূত্র। নাম থাকলেও বদিউল আলম ‘ইসির দায়িত্ব নিতে আগ্রহী’ নন বলে তিনি জানান। প্রস্তাবিত তালিকায় আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বেশ কয়েক আমলার নামও আছে।

যোগাযোগ করলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মত ও পথকে বলেন, ‘আমার প্রস্তাবিত নামগুলো বিএনপির পক্ষ থেকে দিইনি। বিএনপির সার্চ কমিটির কাছে নাম পাঠানো উচিত ছিল।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের দাবি, ‘বিএনপি সার্চ কমিটিতে সরাসরি নাম প্রস্তাব না করলেও অন্যের মাধ্যমে নাম দিয়েছে। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ডা. জাফরুল্লাহ। তিনি সার্চ কমিটির কাছে প্রস্তাব করলে তা বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।’

বিএনপিপন্থি একটি সংগঠনের এক নেতা সার্চ কমিটির কাছে শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ আরো অন্তত তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। তবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির পক্ষে নয়। ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে এমন কয়েকজনের নাম কমিটির কাছে কমিশনার হিসেবে প্রস্তাবিত হয়, যারা বিএনপির প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ হিসেবে মনে করা হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মত ও পথকে বলেন, ‘দলের পক্ষে সার্চ কমিটির কাছে নাম প্রস্তাবের প্রশ্নই আসে না। সরকার তার পছন্দনীয় ইসি গঠন করবে। কমিটিতে নাম পাঠানো, ইসি গঠনে কোনো ভূমিকা রাখা অর্থহীন।’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ‘প্রস্তাবিত তালিকা চূড়ান্ত নয়। সার্চ কমিটি নিজে থেকেই যোগ্যদের খুঁজে বের করবে। প্রকাশিত তালিকার বাইরেও যে কাউকে চূড়ান্ত করতে পারে কমিটি দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীন ইসি গঠনে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ইসি চূড়ান্ত করবেন।’

শেয়ার করুন