যখন একটা দেশের প্রধান নেতা তাঁর মানুষদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন, তখন অনবদ্য একটি কণ্ঠ ভেসে আসছে ওপার বাংলা থেকে। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়/ কী ভালো তোমাকে বাসি আমরা, বলো কী করে বোঝাই….।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি অসংখ্য গানের মধ্যে সবচেয়ে মায়াময় গান হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ঐতিহাসিক গানটিকে। যেটি পরম মমতায় কণ্ঠে তুলেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যিনি গানে গানে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘এ দেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালোবাসলে’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মিয়াওয়ালি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন, সেখান থেকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফেরা উপলক্ষে এই গানটির জন্ম। প্রখ্যাত গীতিকার আবিদুর রহমানের কথায় সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের বাংলায়’ শিরোনামের এই ঐতিহাসিক গানটি সৃষ্টি হয় ১৯৭২ সালে।
গানের কথায় ফুটে ওঠে মমতামাখা কৃতজ্ঞতা। এ দেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালোবাসলে/ সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের এত কাছে কেন আসলে/ এমন আপন আজ বাংলায় তুমি ছাড়া আর কেউ নেই/ বলো কি করে বোঝাই …।
সন্ধ্যার শত গান দুই বাংলার কোটি মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এই গান গেয়ে তিনি আজীবনের জন্য জায়গা করে নেন বাংলাদেশের হৃদয়ে।
এই গান হয়ে ওঠে মাইলফলক। আজও এই গান বাজে, কারণে অকারণে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। সে কারণেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ২০২১ সালে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন। ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের বাংলায়’- শিরোনামে ৭ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের এই তথ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়।
আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সন্ধ্যা বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এভাবে, ‘কত গভীরভাবে দেশকে ভালোবাসলে, ভাষাকে ভালোবাসলে তবে এইভাবে লড়াই করা যায়। ইতিহাসে এ লড়াইয়ের কথা লেখা থাকবে। যুগ যুগ ধরে এ কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
বাংলার সংগীত জগতের এক স্বর্ণযুগের অবসান ঘটলো গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে। মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ৯০ বছরের এই কিংবদন্তি।
‘মধুমালতী’র মতো নিজের কণ্ঠের জাদুতে কয়েক দশক ধরে সংগীত জগতকে মাতিয়ে রেখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকায় জন্ম শিল্পীর। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরাগ। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি কান্নান, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ির কাছে তার শিক্ষা শুরু। ছিলেন ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর শিষ্য। মুম্বাইয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মনের মতো সংগীত পরিচালকের তত্ত্বাবধানে ‘আঞ্জন গড়’, ‘তরানা’র মতো সিনেমার গানে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
প্রায় ১৭টি হিন্দি ছবির জন্য গান গাওয়ার পর ব্যক্তিগত কারণে কলকাতায় চলে আসেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই থেকে শুরু বাংলার সুরেলা জগতের এক নতুন অধ্যায়। ‘সপ্তপদী’, ‘পথে হল দেরী’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘দেওয়া নেওয়া’, ‘পিতা-পুত্র’– একের পর এক সিনেমায় তার কণ্ঠের জাদু শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে বললে কম বলা হবে। বলা যায়, বাঙালির সাংস্কৃতিক মননে যোগ করেছে এক অভূতপূর্ব মাইলফলক। একসময় নাকি সুচিত্রা সেনের কণ্ঠ হিসেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকেই ভাবতে পারতেন না সংগীত পরিচালকরা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটিবেঁধে বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন গীতশ্রী। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ‘জয় জয়ন্তী’, ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমায় গান গেয়ে। পেয়েছেন বঙ্গ বিভূষণ। ১৯৬৬ সালে কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শিল্পীর গাওয়া বহু গানের কথাই শ্যামল গুপ্তর লেখা।