এই পথ যদি না শেষ হয়… কালজয়ী এই গানের রেশটা রেখে জাগতিক কোলাহল স্তব্ধ করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রস্থানে বাংলা সংগীতাঙ্গনে উঠেছে শোকের রোল।
মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা নাগাদ বাংলার এই প্রবাদপ্রতিম গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে।
লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের সপ্তাহ না ফুরাতেই ফের ধাক্কা সংগীতবাংলায়। বাংলার শিল্পীদের মন্তব্য, ‘গানের জগতে মাতৃবিয়োগ ঘটলো।’
ভারতের ওস্তাদ রাশিদ খান বললেন, ‘রাজ্য সংগীত একাডেমিতে দেখা হতো সন্ধ্যাদির সঙ্গে। খুব মজার মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি দিদিকে। এতবড় শিল্পী আমাদের মধ্যে আর নেই। আমাদের মাথার ওপর থেকে ছাদ চলে গেল। ক্লাসিক্যাল গাইতেন। প্রায়ই আমার সঙ্গে বন্দিশ নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতেন কীভাবে গাইলি? উনি ক্লাসিক্যাল শিখেও সিনেমায় এত গান গেয়েছেন, এটা খুব কম শিল্পী পারেন। আমার মায়ের মতোই ছিলেন।’
সংগীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র বললেন, ‘বম্বেতে গান করতে এসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। লতাজির সঙ্গে তখন ওঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। দুই গায়িকার খাওয়াদাওয়া নিয়ে আড্ডা হতো দেদার। দুই আইকন এভাবে পরপর চলে গেলেন। কিন্তু মানুষকে তো একদিন বিদায় নিতেই হয়। প্রবাসী বাঙালি হয়ে ছোটবেলা থেকেই সন্ধ্যাদির গান শুনেছি। বাংলা থেকে দূরে থেকে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া মানেই আমার কাছে ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান।’
শ্রাবণী সেনের মন্তব্য, ‘আমি আর দিদি ইন্দ্রাণী গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে। এত সাধারণ। নিজে হাতে মিষ্টি এনে দিয়ে আমাদের খেতে বলছেন। মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, মেয়েদের রেওয়াজ কেমন চলছে? আমরা তখন উঠতি। এত অনুপ্রেরণা যোগাতেন বলার ভাষা নেই। আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে আর দিদিকে শেখাতেন, এভাবে রেওয়াজ করো। অনেক স্নেহ পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। আমাদের কাছে উনি মাতৃস্থানীয়। ওঁর ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে আর দিদিকে গাইতে বললেন।’
শিল্পী জয় সরকারের মন্তব্য, ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেই একটা ইনস্টিটিউশন। আধুনিক বাংলা গানের বটগাছ। কোভিডেও নিয়মিত আমাদের খবর নিয়েছেন। ফোন করেছেন। সাবধানে থাকতে বলতেন বারবার। অত বড় শিল্পী তো বটেই কিন্তু আমাদের কাছে উনি মায়ের মতো। সন্তানের মতো দেখতেন আমাদের। আমার কম্পোজিশন শুনে একবার বলেছিলেন, আমার বয়স যদি আরও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর কম হতো, তাহলে তোমার করা সুরে গাইতাম। এটা আমার কাছে কত বড় পাওনা বলে বোঝাতে পারব না।’
‘লতা মঙ্গেশকর যেদিন চলে গেলেন সন্ধ্যাদির জন্য তখন থেকেই চিন্তা হচ্ছে। লতাজিকে গানের মধ্যে পেয়েছি। কিন্তু ওঁকে পেয়েছি মায়ের মতো। ওঁর মতো শিল্পী দেখিনি যিনি জুনিয়রদেরও খোঁজখবর নিতেন। আমি ভাবতে পারছি না। রেওয়াজ করেছি ওঁর সঙ্গে। উনি ফোন করলে ১-২ ঘণ্টার আগে ফোন ছাড়তেন না। এত মমতাময়ী ছিলেন কী বলব। আমাকে খুব লাই দিতেন…’- বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সংগীতশিল্পী শিবাজী চট্টোপাধ্যায়।
মাধবী মুখোপাধ্যায় শোকপ্রকাশ করে বললেন, ‘বাংলার স্বর্ণযুগের গায়িকা… সন্ধ্যাদির যখন প্রথম গান বের হলো তখন আমি খুব ছোট। যখনই সন্ধ্যাদির সঙ্গে কোথাও গিয়েছি উনি এই গানটা শুনতে চেয়েছেন আমার কাছ থেকে। এরকম সম্পর্ক ছিল। আমার শ্বশুরবাড়ির সামনেই ওঁর বাড়ি। বিয়ের পর এসে নিজে হাতে গানের ক্যাসেট দিয়ে গেছেন। ওঁর মেয়ের জন্মদিনে গেছিলাম ভেজিটেবল চপ ভেজে দিয়েছেন। সন্ধ্যাদিকে যখন একবার পুরস্কৃত করা হচ্ছিল, উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, বর্ধমানে শুটিং ছেড়েই ওখানে গেলাম। সেই মঞ্চেও গাইতে বললেন আমাকে। উনি কখনও আমার মা, কখনও আমার বন্ধু ছিলেন। আজ গানের জগতে মাতৃবিয়োগ হল।’
সংগীতশিল্পী রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘আমি বাকরুদ্ধ। লতাজি যেরকম ছিলেন সেরকমই ছিলেন সন্ধ্যাদি। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলির শেষ ছাত্রী ছিলেন উনি সম্ভবত। রাগ সংগীতের ছাত্র হওয়ায় ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা হতো। আমরা রাগ, বন্দিশ নিয়ে আলোচনা করতাম।’
সংগীত পরিচালক জিৎ গাঙ্গুলি বললেন, ‘আমার ভাষা নেই। কিছুদিন আগে লতাজি, আর আজ আমাদের গীতশ্রী। এটা কত বড় একটা ক্ষতি আমাদের সংগীতজগতের, কী বলব! সন্ধ্যাদির মতো শিল্পী আর দ্বিতীয়টা হবে না। অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে। কিছুদিন আগে অবধি কথা হয়েছে। আমার সৌভাগ্য হয়নি ওঁর সঙ্গে কাজ করার, কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমাকে শিখিয়েছেন।’
বাংলার সংগীত জগতের এক স্বর্ণযুগের অবসান। প্রয়াত হলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রাত ৮টা নাগাদ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ৯০ বছরের এই কিংবদন্তি।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস