প্রস্তাবিত তালিকায় নাম থাকায় কেউ খুশি, কেউ বিব্রত

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) কে কে থাকতে পারেন এমন একটি প্রস্তাবিত তালিকা রাষ্ট্রপতি গঠিত অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) কাছে জমা দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ও পেশাজীবী সংগঠন। সোমবার রাতে এমন ৩২২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সার্চ কমিটি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া সেই তালিকায় রয়েছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নাম। প্রকাশিত তালিকায় অন্তত ৭ জনের নাম দুইবার করে রয়েছে। এ হিসেবে ৩১৫ জনের নাম রয়েছে তালিকায়। এর মধ্যে সাবেক আমলাদেরই প্রাধান্য, ৮৯ জন। এরপরই রয়েছেন আইন পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরা।

সাবেক দুই প্রধান বিচারপতিসহ ১৫ বিচারপতির নাম এসেছে। রয়েছে ২৩ জন বিচারকের নাম। এছাড়া ২৬ আইনজীবীর নামের প্রস্তাবও এসেছে। সশস্ত্র বাহিনীর ২৭ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সাবেক তিন মহাপরিদর্শকসহ নয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। অপরিচিত ও অখ্যাত বেশ কয়েকজনের নামও তালিকায় দেখা গেছে।

এসব নামের মধ্য থেকে সার্চ কমিটি সিইসি ও ইসি পদে নিয়োগের জন্য একেকটি পদের বিপরীতে দুজন করে ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। সেখান থেকে একজনকে সিইসি ও চারজনকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।

সাবেক প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছির হোসেন (প্রকৃত নাম জে আর মোদাচ্ছির আলী) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং মোহাম্মদ শফিউল আলমের নাম তালিকায় রয়েছে। আছেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) হারুনুর রশিদ ও জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক ও ছহুল হোসাইনের সঙ্গে সাবেক দুজন পুলিশপ্রধানের নামও তালিকায় রয়েছে।

শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশিদ; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ছাড়াও সাংবাদিক অজয় দাসগুপ্ত ও ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নাম তালিকায় রয়েছে।

পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ ও মোহাম্মদ সাদিক, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল করিম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল ও মুহিবুল হক, এফবিসিসিআই সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা জেসমিন টুলির নামও তালিকায় রয়েছে। 

জেনে নিন সার্চ কমিটিতে নাম আসায় কার কী প্রতিক্রিয়া

এদিকে ওয়েবসাইটে এই তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘শুকরিয়া’ আদায় করে পোস্ট দিয়েছেন৷ আবার কেউ কেউ এভাবে নাম প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন৷ কেউ বলেছেন, দায়িত্ব নিয়ে সারা জীবনের অর্জন খোয়াতে চান না৷ আবার কেউ বলেছেন, দায়িত্ব পেলে তা নিতে রাজি আছেন। কেউ তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আনুষ্ঠানিক চিঠিও দিয়েছেন।

তালিকায় নাম আসায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক। মঙ্গলবার শাহদীন মালিক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। তিনি বলেন, আমি এই পদের জন্য আমার নাম প্রস্তাব করিনি এবং কেন এই তালিকায় আমার নাম রয়েছে তা নিশ্চিত নই। আমি এতদ্বারা উল্লিখিত নামের তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার নাম প্রত্যাহার করার জন্য লিখছি এবং ইসির কোনো পদের জন্য বিবেচিত হতে চাই না।

সার্চ কমিটির তালিকায় থাকা সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, তালিকায় আমার নাম প্রকাশ হওয়ায় আমি বিব্রত৷ আমার নাম কে দিয়েছেন তাও আমি জানি না৷ আমরা অনুমতিও নেওয়া হয়নি৷ এতে ব্যক্তি হিসেবে আমাকে বিব্রত করা হয়েছে৷ আবার একটি সাংবিধানিক পদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে৷

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তালিকায় আমার নাম প্রকাশ করায় আমি বিব্রত নই৷ তবে আমি নির্বাচন কমিশনে যেতে আগ্রহী না৷ নাম প্রকাশের পর তা জানিয়ে দিয়েছি৷

তালিকায় নাম থাকা চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই। বর্তমানে একটি কাজে ঢাকার বাইরে রয়েছি। আগে বিষয়টি সম্পর্কে জানি, তারপর এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার গণমাধ্যমকে জানান, কে তার নাম দিয়েছে, তা তিনি জানেন না। এরপরেও ইসিতে দায়িত্ব দেওয়া হলে যাবেন কি না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।

পুলিশ সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকও জানান, দায়িত্ব পেলে তা গ্রহণ করবেন তিনি।

সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান জানান, ইসিতে রাখা হলে যাবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত তিনি পরে নেবেন।

তালিকায় নাম আছে শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, ‘এসবের মধ্যে যেতে চাই না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমার চাইতে আরও অনেক বেশি যোগ্য লোক প্রস্তাবিত তালিকায় রয়েছেন। আমি মনে করি, তারা দায়িত্বে এলে ভালো হবে।

সাবেক অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমার সারা জীবনে যা অর্জন, তা আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়ে খোয়াতে চাই না। অনুমতি ছাড়া এভাবে নাম দেওয়া বিব্রতকর।’

তবে তালিকায় নাম থাকা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ জানিয়েছেন, তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মানুষের যে বিরূপ ধারণা, তা নিরসনে যথাযথভাবে কাজ করবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘মাত্র তো নামের প্রস্তাব এসেছে, দেখা যাক কী হয়।’

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘এখানে অনেক মানুষের নাম দিয়েছে। যে বা যারা আমার নাম দিয়েছে, তারা আস্থার জায়গা থেকে শিক্ষক হিসেবে হয়তো আমার নাম দিয়েছে।’

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী জানান, তালিকায় নাম থাকলেও তিনি নির্বাচন কমিশনে যোগ দিতে আগ্রহী নন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, তিনিও জানেন না, তাঁর নাম কে দিয়েছে।

তালিকায় নাম থাকলেও নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নিজের অবস্থানকে বিতর্কিত করতে চান না বলে জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।

সার্চ কমিটিতে আসা নাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সার্চ কমিটির কাছে বিভিন্ন দল, সংগঠন, সুশীল সমাজ ও ব্যক্তি নাম প্রস্তাব করেছে। সেই নামগুলো আমরা প্রকাশ করেছি। এখানে যারা নাম জমা দিয়েছে, তারা কোনো অনুমতি নিয়েছে কি না, সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। পরবর্তী সময়ে অনুমতির কোনো বিষয় থাকলে আমরা সেটি নিয়ে ভাবব।

শেয়ার করুন