এইডস নেই প্রমাণ করতে যেতে হলো আদালতে, ভেস্তে গেলো বিদেশ যাত্রার স্বপ্ন

ডেস্ক রিপোর্ট

স্বপ্ন ছিল কর্মসংস্থানের উদ্দেশে সৌদি আরব যাবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ফাহিম। মেডিক্যাল পরীক্ষা করান এলাইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তাতেই তার বিদেশ যাত্রার স্বপ্ন ভেস্তে যায়। রক্ত পরীক্ষায় এইচআইভি পজিটিভ আসে। কিন্তু তারপর আরও দুই জায়গায় একই পরীক্ষায় নেগেটিভ আসে। তাতেও তার বিদেশযাত্রা হয়নি। আদালতে দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর তদন্ত করে দেখতে পায় ফাহিম পজিটিভ নন। এখন তা প্রমাণে আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তিনি।

গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিক্যাল সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (গামকা) মধ্যপ্রাচ্য গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন ও ওমানে যেতে আগ্রহীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিবন্ধনপত্র (স্লিপ) নিতে হয় গামকা কার্যালয় থেকে। গামকার দেওয়া নিবন্ধনপত্র নিয়ে নির্ধারিত মেডিক্যাল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়।

গত বছরের ২৭ জুন ও ২৮ জুন এলাইড ডায়াগনস্টিক লিমিটেডে রক্ত পরীক্ষা করান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফরহাদ হোসেন ফাহিম। দুই দিনের রিপোর্টে বলা হয় তিনি এইচআইভি পজিটিভ। ন্যাশনাল এইচআইভি টেস্টিং সার্ভিসেস গাইডলাইন ২০১৯ অনুযায়ী, যেকোনও এইচআইভি টেস্টিং সেন্টারে পজিটিভ শনাক্ত হলে তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি হাসপাতালে পুনরায় পরীক্ষার জন্য রেফার করার নির্দেশনা আছে। কিন্তু এলাইড ডায়াগনস্টিক তা না করে ফাহিমকে শারীরিকভাবে অক্ষম (মেডিক্যালি আনফিট) রিপোর্ট তৈরি করে গামকার কাছে পাঠিয়ে দেয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দিয়ে বলা হয় তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। মূলত তাতেই সৌদি আরব যাওয়ার আশা ভেস্তে যায় ফাহিমের।

কিন্তু ফাহিম তাতে দমে না গিয়ে নিজে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআর,বি) পুনরায় পরীক্ষা করান। তাতে ফলাফল আসে নেগেটিভ। ফাহিম সেই রিপোর্ট নিয়ে এলাইড কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও তারা কোনও সমাধান দিতে পারেনি। ফাহিমের অভিযোগ—তার কাছে অর্থের বিনিময়ে ‘ফিট’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

ফাহিমের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকায় ফাহিম এইচআইভি আক্রান্ত জানাজানি হয়ে গেলে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করা হয়। এসব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া ফাহিমের পরিবার আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ দিন পার করছেন ফাহিম ও তার পরিবার। এসব সমস্যা নিয়ে তারা গত বছর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমনের শরণাপন্ন হন। গেলো বছরের ডিসেম্বরে তিনি হাইকোর্টে একটি রিট করেন।

গত ১২ ডিসেম্বর রিটের প্রাথমিক শুনানিতে এইচআইভি পজিটিভ প্রতিবেদন দিয়ে এক ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় বাধা দেওয়ার ঘটনা বিস্তারিত তদন্ত করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে (ডিজি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই ব্যক্তির পুনরায় এইচআইভি পরীক্ষা করে ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এছাড়া শুনানিতে ওই ব্যক্তিকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না সেই মর্মে রুল জারি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টে স্বাস্থ্য অধিদফতর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। সেটি ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে উত্থাপন করা হয় বলে জানান ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, গত ২৭ জানুয়ারি সকালে এলাইড ডায়াগনস্টিক পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত কমিটি। অভিযোগকারী ফাহিমের দুই দিনের রিপোর্টে পজিটিভ এলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর,বি’র রিপোর্টে নেগেটিভ আসে। পজিটিভ হওয়ার তথ্য এলাইড কর্তৃপক্ষ ৩০ জুন গামকাকে অবহিত করে এবং তার দুই মাস পর স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চিঠি দিয়ে জানায়। পরে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত টিম পুনরায় ৩১ জানুয়ারি এলাইড ডায়াগনস্টিক, বিএসএমএমইউ এবং আইসিডিডিআর,বিতে পরীক্ষা করায় এবং সব পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ আসে। তদন্ত কমিটি মনে করে—প্রাথমিকভাবে পজিটিভ আসার পর তথ্যটি অনলাইনে প্রকাশ না করে এলাইড কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (স্বাস্থ্য অধিদফতর) যথাসময়ে অবহিত করে নির্ধারিত সেন্টারে রেফার করা উচিত ছিল। কারণ, বিএমডিসি কোড অব প্রফেশনাল কন্ডাক্ট এটিকেট এবং এথিকস-এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ অনুযায়ী আইনগত বাধ্যবাধকতা কিংবা জনস্বার্থ ছাড়া কোনও রোগীর গোপন তথ্য কোনও চিকিৎসক বা ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালের কারও কাছে প্রকাশ করতে পারবে না।

আদালতে বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকায় এলাইড কর্তৃপক্ষ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন বলেন, আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরকে তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা আগের শুনানিতে বলেছিলেন। সেটি আদালতে জমা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে পুনরায় সব জায়গায় আবার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে তার এইচআইভি নেই। এলাইড কিন্তু ফাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবং বলেছিল সিস্টেম করে রিপোর্ট ঠিক করা যাবে। ওরা আর যোগাযোগ না করায় রিপোর্ট গামকা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা আবার তখন চিঠি দিয়ে বললাম যে তার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে, আপনারা ব্যবস্থা নিন গামকা থেকে রিপোর্ট সরানোর জন্য। মন্ত্রণালয় আর কোনও ব্যবস্থা নিলো না। এ জন্য আমরা রিট করলাম।

তিনি আরও বলেন, আজ আদালতকে জানালাম যে তার নামে যে রিপোর্ট হয়েছে সেটা সরানো প্রয়োজন। আদালত বুধবার শুনানির দিন ধার্য করলেন এবং এলাইড কর্তৃপক্ষকে আইনজীবী নিয়োগের জন্য বলেছেন। আর বলেছেন, প্রয়োজন মনে করলে রিপোর্ট সরানোর জন্য আরেকটা আবেদন করতে। আমি সেটা দিয়ে দিচ্ছি আবার। আমরা একটি রুল পেয়েছি ২১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না মর্মে।

শেয়ার করুন