‘দুদকের শরীফকে অপসারণ অসাংবিধানিক-মানবাধিকার পরিপন্থি’

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুদক কর্মকর্তা শরীফকে অপসারণের প্রতিবাদে সহকর্মীদের মানববন্ধন

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা। একই দাবিতে তারা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথমে দুদক সচিবকে দাবি-দাওয়া সংবলিত স্মারকলিপি দেন তারা। পরে দুপুর ১২টার পর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের প্রতিবাদে মানববন্ধন করা হয়।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনোরূপ অপরাধ করেছেন কি না, তা অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থি। আদালতে বিচারাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিতর্কিত ৫৪(২) ধারা মোতাবেক শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিলের দাবি জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারীরা।

‘দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারী হিসেবে আমরা দুদকের মিশন-ভিশন বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করি, যার নজির রয়েছে দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার চলমানও রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চাকরি বিধিমালা (কর্মচারী)-২০০৮-এর ৫৪(২) বিধিতে বলা হয়েছে, এ বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারবে।’

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থাগ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’

‘দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮-এর ৫৪ বিধি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-১৪২৪/২০১১ দায়ের করা হলে ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগ দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪ বিধিকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আদালত ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের ৫৪ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণাটি বহাল রাখেন। অর্থাৎ ৫৪ বিধি অনুযায়ী দুদকের কোনো কর্মচারীকে সংবিধানের ২৭, ২৯, ২১ ও ৪০ অনুচ্ছেদবলে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে কাউকে ৯০ দিনের বেতন দিয়ে স্থায়ী রাজস্ব খাতভুক্ত চাকরি থেকে অপসারণের অবকাশ ছিল না। কিন্তু কমিশন আপিল বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের বিপরীতে ৩২/২০১৭ সিভিল রিভিশন করলে একতরফা (রিটকারীর প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে) শুনানি করে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত করেন এবং বিষয়টি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪ বিধির কার্যকারিতার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দুদকে ২০১৪ সালে যোগদান করা একজন কর্মকর্তাকে কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনোরূপ অপরাধ করেছেন কি না, সে বিষয়টি তাকে অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থি।’

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘মো. শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি তার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ৫২টি মামলা করেন। এছাড়া তিনি আদালতে বিচারের জন্য ১৫টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) প্রস্তুত ও দাখিল করেন। শরীফ উদ্দিন কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শরীফ উদ্দিনের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে সংক্ষুব্ধ পক্ষগুলো বিভিন্ন সময়ে তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। অথচ ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ারই সমার্থক।’

‘এমতাবস্থায় মো. শরীফ উদ্দিনকে অসাংবিধানিক ও অমানবিক অপসারণ আদেশ প্রত্যাহার ও দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধি বাতিলপূর্বক কমিশনের কর্মকর্তাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর সই করা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে গত বছরের জুনে তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল।

শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের নির্দেশ দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪(২)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দিন, উপ-সহকারী পরিচালক, দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’ এ আদেশ ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ হয়। তবে প্রজ্ঞাপনে অপসারণের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

জীবননাশের হুমকি পেয়ে শরীফ উদ্দিনের জিডি

গত ৩০ জানুয়ারি দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামের খুলশী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যার নম্বর ১৬৪৫। জিডিতে তিনি পেট্রোবাংলার অধীনস্থ ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (পিআরএল) মো. আইয়ুব খান চৌধুরী ও তার সহযোগীর নাম উল্লেখ করেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবননাশের শঙ্কায় রয়েছেন জানিয়ে জিডিতে তিনি নিরাপত্তা চেয়েছেন।

শরীফের দুর্নীতিবিরোধী আলোচিত যত অভিযান

চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালে ২০২১ সালের ১৬ জুন ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। একই বছর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই কার্যালয় তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে শরীফ উদ্দিনের তদন্তে।

কক্সবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলাও করেন তিনি। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে নামে দুদক। পরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও বেশ কয়েকটি মামলা করেছিলেন শরীফ উদ্দিন।

তবে ২০২১ সালের ১৬ জুন দুদক পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলামের সই করা এক অফিস আদেশে মো. শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।

শেয়ার করুন