ইসিতে নারী অন্তর্ভুক্ত হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে

খুশী কবির

নির্বাচন কমিশন
ফাইল ছবি

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এখন সংবাদমাধ্যম সরগরম। প্রথমবারের মতো আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যে ‘সার্চ কমিটি’ গঠিত হয়েছে, তারা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকেও ইতোমধ্যে সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনারদের নামের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। আসন্ন সেই নির্বাচন কমিশনে যে কমপক্ষে একজন নারী রাখা হবে- এটা অনেকটা অনিবার্য। কারণ বিদায়ী নির্বাচন কমিশনেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিশনের নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু আরও বেশি সাধুবাদযোগ্য হবে যদি যোগ্যতার বিচারে নারী কমিশনার যুক্ত হন। এমনকি যথোপযুক্ত যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও একজন নারী অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। তার মানে, পুরুষ-মহিলার চেয়ে বড় বিষয় হলো যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া। কোনো অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনে একাধিক নারী কমিশনারও নিয়োগ পেতে পারেন, যদি তাদের যোগ্যতা থাকে।

universel cardiac hospital

আমরা দেখছি, নির্বাচন কমিশনে কমপক্ষে একজন নারী রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনজন রাখা যাবে না- এমন কথা তো বলা হয়নি। তাই যদি একাধিক যোগ্য নারী পাওয়া যায়, তাদের রাখা হোক। আগেই বলেছি, নারী-পুরুষ সবাই রুটিন ওয়ার্ক করে। কিন্তু নারী প্রতিনিধি থাকলে নারী প্রার্থী বা ভোটাররা অনেক সময় তাদের একান্ত কথা বলার সুযোগ পেতে পারে। যদিও আমাদের দেশে সেই প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই এখানে নারীকে অলঙ্কার হিসেবে বসিয়ে রেখে লাভ নেই। বরং যে নারী কাজ করতে পারবেন, তাকে বা তাদের নিয়োগ দিতে হবে। কারণ নির্বাচন কমিশনে নারী সদস্যকে নির্বাচনকালীন ও আগে-পরে অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যোগ্য নারী না রাখলে রাখার জন্য রেখে কোনো ভালো ফল আশা করা যায় না।

আগেই বললাম, বিদায়ী নির্বাচন কমিশনেও একজন নারী কমিশনার ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা তার দৃশ্যমান ভূমিকা দেখতে পাইনি। তিনি আরও বলিষ্ঠ হতে পারতেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তিনি নারী ভোটার ও নারী প্রতিনিধিদের ব্যাপারে আরও বেশি দায়িত্বশীল হবেন। আরও সংবেদনশীল হবেন কমিশনার নারী-পুরুষ সবারই সমান দায়িত্বে। কিন্তু নারী কমিশনারের কাছে আমাদের আলাদা প্রত্যাশা থাকে। সেটা গত কমিশনে লক্ষ্য করিনি।

২০১৯ সালে সুবর্ণচরে একজন প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ায় ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে এক নারীকে। এ ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। অথচ এখানে নির্বাচন কমিশন আরও ভালো কিছুর প্রতিফলন ঘটাতে পারত। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটাররা নানা সময়ে প্রভাবশালীদের হুমকির মুখোমুখি হয়। নির্বাচনকালীন বা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এসব পরিবারের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। আমরা মাহিমা-পূর্ণিমার কথা ভুলে যাইনি। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয়, তাহলে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। যে কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করতে হলে কমিশনের অনুমতি লাগে। অতএব এ সময় কোনো অন্যায় কাজ হলে তার দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না।

মোট কথা, আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক, যারা সরকারের স্বার্থ দেখবে না। বরং রাষ্ট্র ও সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সে রকম যোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে। দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি সার্চ কমিটির কাছে কোনো নাম জমা দেয়নি। বিএনপি যদি পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আর এখন সার্চ কমিটির কাছে নাম না দেয়, তাহলে বিষয়টি বেমানান হবে। কারণ তাদের প্রতিনিধি সংসদে আছে। তারা নির্বাচন কমিশন আইনটি পাসের সময় জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এমনকি বিলে সংশোধনী দিয়ে বক্তব্যও রেখেছে। কিন্তু আইনটি পাসের পর তারা কেন নাম দিল না, সেটা তাদের রাজনৈতিক বিষয়। আমি মনে করি, যদি তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে নাম দিতে পারত।

সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রের নানা সুবিধা ভোগ করেন। সুতরাং রাষ্ট্রের কাছে তাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। দলীয় স্বার্থে পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি না করে দেশ ও মানুষের স্বার্থে তাদের কথা বলা উচিত। রাজনৈতিক দল হিসেবে সবারই প্রত্যাশা – পরবর্তী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। সে কারণে বিএনপি যোগ্য ব্যক্তির নামের তালিকা জমা দিতে পারত। কিন্তু সেটা না করে কাদা ছোড়াছুড়ি কখনোই ভালো ফল বয়ে আনবে না।

জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে নির্বাচন কমিশন তাদের সময় বাড়িয়ে দিল। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছি। আমি তো বলব ৩৩ নয়; ৫০ ভাগ নারী সদস্য নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সংবিধান নারীদের সমান অধিকারের কথা বলেছে। তাই তাদের অংশগ্রহণ সমানই করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য নারী প্রতিনিধি খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতে সময় নিচ্ছে। পুরুষের ক্ষেত্রে তো এত যোগ্যতা-অযোগ্যতা দেখা হয় না। তাহলে নারীর ক্ষেত্রে এত বাহানা কেন? আমরা দেখেছি, দুর্নীতি ও মামলায় সাজা হওয়ায় অনেক পুরুষ সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হচ্ছে। তাহলে সেখানে তাকে মনোনয়ন দেওয়ার আগে কি যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল? শুধু নারীর ক্ষেত্রে শতভাগ যোগ্যতার কথা বলা হলে কীভাবে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র তৈরি হবে? পুরুষের বেলায় যেসব যোগ্যতা খোঁজা হয় না; নারীর বেলায় সেসব যোগ্যতা কেন খোঁজা হবে? বরং আমরা অতীতে দেখেছি, সমাজ বা রাষ্ট্রে কোনো ধরনের অঘটন হলে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি এগিয়ে আসে।

আমাদের সংবিধানে নারীকে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেক স্থানে নারীকে রাখা হলেও তাদের কাজের পরিবেশ দেওয়া হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীকে রেখে তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এসব স্থানে শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার জন্য বা অলঙ্কার হিসেবে নারী প্রতিনিধিত্ব রাখা হচ্ছে। ‘আলঙ্কারিক’ এই ধারা বদলে ফেলতে হবে।

আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক, যারা ভোটার ও প্রার্থীর অধিকার রক্ষা করতে পারবে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতায় অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তারা এ দায় এড়াতে পারে না। যদিও তাদের মেয়াদের শেষে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা তুলনামূলক কম হয়েছে। এটা যদি অন্য নির্বাচনে হতো, তাহলে খুশি হতে পারতাম। শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়; অন্যান্য নির্বাচনেও বিদায়ী কমিশন বিতর্কিত হয়েছে। আমরা আশা করব, নতুন কমিশন পূর্বসূরিদের বদনাম ঘুচিয়ে জাতিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।

খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি

শেয়ার করুন