ইউরোপে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ব্রিটেন ও আমেরিকার তর্জন-গর্জন ক্রমেই নেতিয়ে আসছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কূটনীতির কাছে পশ্চিমা শক্তি আগেও হেরেছে; এবারও হারবে মনে হয়। পুতিন কি ইউক্রেন আক্রমণ করবেন? মোটেই না। বাইডেন কি রাশিয়া আক্রমণ করবেন? মোটেই না। তাহলে এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা কেন? একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, ক্রুশ্চেভের নীতির সঙ্গে পুতিনের নীতির অনেকটা সামঞ্জস্য আছে। ভয়াবহ কিউবা সংকটে আমরা লক্ষ্য করেছি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবার উপকূলে সৈন্য মোতায়েনের আদেশ দিয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবাকে অর্থনৈতিক অবরোধ দ্বারা কাবু করতে না পেরে, এমনকি কিউবাতে জাল মুদ্রা ছড়িয়ে তার সমাজতন্ত্রী অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে না পেরে প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবার ওপর সামরিক অবরোধ আরোপের চেষ্টা করেন। সম্ভবত তার ইচ্ছা ছিল কিউবায় ‘রেজিম চেঞ্জ’। তৎকালীন সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ কেনেডির উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে কিউবায় আণবিক বোমা স্থাপনের ঘোষণা দেন। আণবিক বোমা নিয়ে রুশ জাহাজ ‘বে অব পিগ্স’-এ পৌঁছে যায়। কেনেডিও ঘোষণা করেন- রাশিয়া কিউবায় আণবিক অস্ত্র স্থাপন করলে তিনি যুদ্ধে নামবেনই।
ঠিক আজকের ইউক্রেন নিয়ে যে সংকট, সেই সংকট তখন কিউবাকে নিয়েও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু চতুর ক্রুশ্চেভ আণবিক অস্ত্রবাহী জাহাজ কিউবায় পাঠালেও সেখানে আণবিক ঘাঁটি স্থাপন করেননি। আণবিক বোমাবাহী রুশ জাহাজ রাশিয়ায় ফিরে গিয়েছিল। তার কারণ আমেরিকা তার সেনাবাহিনী কিউবার উপকূল ‘বে অব পিগ্স’ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এতে বোঝা যায়, ক্রুশ্চেভের নীতি ছিল যুদ্ধ করা নয়। চাপ দিয়ে পশ্চিমা শক্তির যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা বন্ধ করা।
ইউক্রেনেও আজ একই নাটকের পুনরাভিনয় চলছে। আমেরিকা মনে করেছিল, রাশিয়া তার সঙ্গে অঙ্গীভূত ক্রিমিয়া দখল করার পর ইউক্রেনের দিকে আগাবে। ইউক্রেন রাশিয়ার অত্যন্ত নিকটতম প্রতিবেশী। ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলে। রাশিয়ার সামাজিক প্রথা সেখানে প্রচলিত। রাশিয়া ইউক্রেনকে নিজেদের দেশই মনে করে। ইউক্রেনবাসীও তাই মনে করত। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো প্রচার চালিয়ে ইউক্রেনিয়ানদের মৃত জাতীয়তাবাদকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। কিয়েভে তাদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কাশ্মীরের বর্তমান সরকার যেমন ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্যে ক্ষমতায় আছে; ইউক্রেনের কিয়েভেও তাই। পুতিন এতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন, আমেরিকা তাকে সৈন্যবাহিনী দ্বারা ঘেরাও করার চেষ্টা করবে না। কিন্তু আমেরিকা রুশ আক্রমণ থেকে ইউক্রেনকে রক্ষার নামে ক্রমশ বোমা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে এবং সম্প্রতি দেশটিকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এটা ছিল রাশিার জন্য এক বিরাট হুমকি। রাশিয়ার সীমান্তের একেবারে কোলের কাছে ন্যাটোর সাহায্যে আণবিক বোমার ঘাঁটি স্থাপন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য এক ভয়ানক হুমকি। এই হুমকির পাল্টা হুমকি হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে বিপুলভাবে সেনা-সমাবেশ করেছে। ইউক্রেন থেকে পশ্চিমা শক্তিকে সরানোর জন্য এটা রাশিয়ার পাল্টা চাল। সংকটের গোড়া থেকেই এটা বোঝা গিয়েছিল, রাশিয়া যুদ্ধে নামবে না। তারা পশ্চিমা শক্তির ওপর চাপ দিয়ে ন্যাটোকে ইউক্রেনে ঢুকতে না দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। এটা দরকষাকষি; যুদ্ধ নয়। কিন্তু আমেরিকা বিশ্বময় এই যুদ্ধের ঢাক পিটিয়েছে। বাইডেনের পুড্ল জনসন ঢাক পিটিয়েছেন আরও বেশি। এভাবেই সারা ইউরোপে যুদ্ধ-শঙ্কা সৃষ্টি? করে আমেরিকা একদিকে পুতিনকে ধমকাতে চায়, অন্যদিকে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে যে পচন ধরেছে, সেই পচনকে রোধ করতে চায়।
এখানে আগেকার দুটো যুদ্ধের ফল উল্লেখ করছি। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেন ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে আকস্মিকভাবে মিসর আক্রমণ করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন- তারা তিন দিনের ভেতরে কায়রো দখল করবেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট তখন জামাল আবদেল নাসের। তিনি এই যুদ্ধে চরম সাহস দেখান এবং রাশিয়া ঘোষণা করে- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করা না হলে তারা মিসরের সাহায্যে হস্তক্ষেপ করবে। এই নোটিশ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ বন্ধ করে। এর ফল অ্যান্থনি ইডেনের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত হওয়া। তার রাজনীতি সেখানেই শেষ। আরেকটা যুদ্ধ প্রেসিডেন্ট কেনেডি শুরু করেছিলেন ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। ফল যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দলে দলে মার্কিন সেনার পলায়ন। সুতরাং বর্তমানেও যুদ্ধে নামলে আমেরিকার অবস্থা কী হবে, তা প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা কথা বলেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের পর, ‘মারণাস্ত্র দ্বারা যে জনগণের সম্মিলিত মনোবলকে ধ্বংস করা যায় না- ভিয়েতনাম তার প্রমাণ।’ বঙ্গবন্ধু নিজেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এটা প্রমাণ করেছেন।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে আণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ার আগে এবং পরে আমেরিকার যুদ্ধ জয়ের কোনো ইতিহাস/দৃষ্টান্ত/নজির নেই। প্রথম, কোরিয়ান যুদ্ধে তার পরাজয় লজ্জাজনক। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় আরও লজ্জাজনক। আফগান যুদ্ধে নামার সময় আমেরিকাকে অনেক পর্যবেক্ষক সাবধান করেছিলেন এই বলে- আফগানিস্তান আমেরিকার জন্য আরেকটি ভিয়েতনাম হতে পারে। কিন্তু আফগানিস্তান ভিয়েতনামের চেয়েও আমেরিকার জন্য আরও লজ্জা ডেকে এনেছে। আমেরিকান সেনাদের প্রাণ রক্ষার জন্য, আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পরাজয় এড়ানোর জন্য তালেবানদের ডেকে এনে ক্ষমতা দিতে চেয়েছেন। আর বাইডেন ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া শেষ করেছেন।
এই যুদ্ধগুলোর অর্থনৈতিক ফলাফলও লক্ষণীয়। কোরিয়ান যুদ্ধের পর বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের পাটের চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। তখন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ। তিনি ভারতকে জব্দ করার জন্য একটা ফাঁদ পাতলেন। পাটের দাম বাড়ার দরুন পাকিস্তানের রুপির দাম বেড়ে গিয়েছিল। এ সময় বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার দরুন ভারত তার মুদ্রামান কমিয়েছিল। তারা আশা করেছিল, পাকিস্তানের রুপির অনুরূপভাবে ডিভ্যালুয়েশন করা হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ ঘোষণা করলেন- তারা রুপির দাম কমিয়ে ভারতের রুপির সমান করবেন না। তখন বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তার পাটের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘পাকিস্তানের রুপির রেট না মানলে তারা ভারতের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য করবে না।’ ভারত খুব মুশকিলে পড়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গে তখনও পাট উৎপাদন শুরু হয়নি। হাওড়ার ১০ হাজার চটকল বাংলাদেশের পাটের ওপর নির্ভরশীল। ভারত আর কী করে! পাকিস্তানের রুপির রেট মেনে নিয়ে পাট ক্রয় অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানের সরকারি কাগজগুলো তখন খুব ঢোল পিটিয়েছিল- এটা ভারতের পরাজয় এবং অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ হচ্ছেন ‘অর্থনীতির জাদুকর’।
কিছুদিন পরেই যখন পাটের আন্তর্জাতিক বাজারে ধস নামল, ভারতীয় রুপির আন্তর্জাতিক বিনিময় মান পাকিস্তানের চেয়ে বেড়ে গেল, তখন পাকিস্তান পড়ল বিপদে এবং ভারতীয় রুপির রেটে পাকিস্তানের রুপির রেট নামিয়ে এনে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করেছিল।
কোরিয়ার যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম যুদ্ধের ধাক্কা সারা দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়েছে। ভিয়েতনামের শাসক ছিল ফ্রান্স। দেশের স্বাধীনতার জন্য হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতকংরা যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধে ফরাসিরা পরাজিত হয়। তাদের পরাজয় ঠেকানোর জন্য আমেরিকা বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র নাপাম নিয়ে ভিয়েতকংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু পরাজিত হয় ও পলায়ন করে। এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছিল সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট এবং কমিউনিস্ট আক্রমণের ভয় দেখিয়ে ছোট ছোট দেশে আমেরিকার সেনা মোতায়েন। কিন্তু ভিয়েতনামে তাদের পরাজয় লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটায়।
ইউক্রেন নিয়ে এবারের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপকে ভুগতে হবে। জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ ইউক্রেন হয়ে যে তেল আসে, তার ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ যদি বাধে এবং রাশিয়া যদি তেল সরবরাহ বন্ধ করে, তাহলে ইউরোপের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে। ইউরোপ আমেরিকার উস্কানিতে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। অন্যদিকে, পুতিন ন্যাটোর হুমকি মোকাবিলায় চীনের সঙ্গে দোস্তি করেছেন। এ দুই দেশেরই আণবিক অস্ত্র রয়েছে।
সুতরাং কোরিয়ার যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেমন আণবিক বোমার হুমকি দিয়েছিলেন, এবার তা আর পারছেন না। এবারের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং আমেরিকা ডন কুইকজোটের মতো বৃদ্ধ ঘোড়ায় চড়ে অস্ত্রের শাসানি দেখাতে থাকে, তাহলে তাদের বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে পারবে; কিন্তু বৃহৎ শক্তি হিসেবে আমেরিকার পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এই কথাটা মনে রেখে বাংলাদেশ যদি আমেরিকার হুমকির কাছে মাথা নোয়ায় এবং আমেরিকা যেসব সামরিক দাবি জানাচ্ছে, তা মেনে নেয়, তার ফল ভালো হবে না। শেখ হাসিনা একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি এ কথাটা মনে রেখে তার পররাষ্ট্রনীতি সাজালে ভালো করবেন।
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে ঝগড়া নয়।’ বর্তমান মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত হবে চীন-মার্কিন কোনো শক্তিকেই না চটিয়ে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলেছিল সাত বছর। এই সাত বছর যুদ্ধে তুরস্ক নিরপেক্ষ ছিল। সুইজারল্যান্ডও নিরপেক্ষ ছিল। ইউরোপে হিটলারের আক্রমণের মুখে তারা কী করে এই নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছিল, তা আমি জানি না। তাই এখনও আমাদের যেমন চীনা প্রেমে গদগদ হওয়ার দরকার নেই, তেমনি মার্কিন হুমকির কাছে মাথা নত করার আবশ্যকতা নেই।
বর্তমানের করোনা এবং ইউক্রেন সংকট শেষ হলেই এক নতুন পৃথিবীর চেহারা আমরা দেখব। শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করি, সেই পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে সংহতি বজায় রেখে কীভাবে জাতিকে পরিচালনা করা যায়, তার উপায় বের করুন। আজ আর বিএনপি বড় শত্রু নয়। তার শত্রু দলের ভেতরেই লুকিয়ে আছে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন, ‘আমি বাইরের শত্রুর জন্য ভীত নই। কিন্তু আমার দলের ভেতরের শত্রুদের জন্য ভীত।’ শেখ হাসিনাকে মার্গারেট থ্যাচারের সতর্কবাণীও আজ আবার জানিয়ে দিতে চাই।