৭০ বছরেও হয়নি ভাষাসৈনিক, শহীদদের তালিকা

হাসান শান্তনু

রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পার হচ্ছে। গত সাত দশকের মধ্যে ভাষাশহীদ ও সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা হয়নি। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে অনেকে নিহত হন। শুধু তালিকা না থাকায় তাদের মধ্যে সবাই ভাষাশহীদের স্বীকৃতি পাননি সত্তর বছরেও। এমনকি তালিকা না থাকায় ওই সময় কতোজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তা-ও আজ পর্যন্ত নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। ভাষাশহীদদের মধ্যে অনেকে বেঁচে না থাকায় সেসব তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।

ইতিহাসবিদদের মতে, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দেশের স্বাধীনতার সোপান রচিত হয়। রক্ত নদী পেরিয়ে একাত্তর সালে আসে বিজয়। আন্দোলনের পর দীর্ঘ বছর পর্যন্ত ভাষাশহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা না হওয়া রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। এর দায় কম-বেশি সব সরকারের। আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ না থাকা, সৈনিক ও শহীদদের তালিকা না থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ভাষার জন্য জীবন দেওয়া অনেকের নাম আজও জানা যাচ্ছে না।

ভাষা শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে। এরপরও তা হয়নি। আদালত অবমাননা এড়াতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একবার উদ্যোগ নিয়ে ‘দায়সারা গোছের কিছু একটা করতে গেলে’ এতে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ভাষাশহীদ ও সৈনিকদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে এভাবে সময়ক্ষেপণ করা দুঃখজনক ও হতাশার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সব সরকারকে এ ব্যর্থতার কারণে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে একদিন।

তালিকা তৈরির উদ্যোগ যখন যতোটা নেওয়া হয়েছে, তা শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। অন্য রাজনৈতিক দল ও সামরিক সরকারের আমলে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০২০ সালের ৮ মার্চে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া সৈনিক ও ভাষাশহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে সংস্কৃতি সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের এ তালিকা ছয় মাসের মধ্যে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ তালিকা আলোর মুখ দেখেনি।

ভাষা আন্দোলনে জড়িতদের তালিকা তৈরি করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদেরকে ২০১০ সালেও নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। নির্দেশনায় ঢাকাসহ সব জেলায় তালিকা প্রণয়নে কমিটি গঠন করতে বলা হয়। এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষাসৈনিক, গবেষক আহমদ রফিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয় শুধু ঢাকায়। জেলা পর্যায়ের বিষয়ে কমিটি গঠনে সরকারি কোনো উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়নি।

নির্দেশ অনুযায়ী বা আদালত অবমাননার অভিযোগ এড়াতে সরকার উদ্যোগ নেয়। তালিকা পেতে সরকার তখন বাংলা একাডেমির শরণাপন্ন হয়। একাডেমি থেকে কিছু তথ্য নিয়ে প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষে ৬৮ জনের অপূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তালিকা তৈরির বিষয়ে আদালত স্থগিতাদেশ দেন। এরপর থেমে যায় সরকারের ‘উদ্যোগ’।

ভাষাসংগ্রামী, লেখক আহমদ রফিক মত ও পথকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতোজন আর জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? এ তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভালো আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা। সেসবে কারও আগ্রহ আছে বলে দেখা যায় না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকতা মত ও পথকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যে প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব, ভাষাসৈনিকদের তালিকা সেভাবে সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সবার সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। কেউ সরাসরি যুদ্ধ করেন, কেউ সংগঠক ছিলেন। সেখানে একটা পদ্ধতি বের করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনে এমনটি ছিল না। কী পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা যাবে, সেটা নিয়েও আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে।’

শেয়ার করুন