জয় বাংলা শ্লোগানে ‘আপত্তি’ মাদ্রাসা শিক্ষকদের!

হাসান শান্তনু

আদালতের নির্দেশের প্রায় দুই বছর পর জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান, সংস্থায় জয় বাংলা বলা বাধ্যতামূলক হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

তবে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষকদের ‘আপত্তি’ আছে আলোচনা ও বক্তব্য শেষে এমন ‘অপ্রয়োজনীয় বাংলা শব্দ’ উচ্চারণে। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাগুলোর। তারা একে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মতো ‘শিরক’ মনে না করলেও ‘সওয়াবহীন’ বলে মনে করছে। ধর্মীয় শিক্ষানীতিতে ‘অবিচল’ থাকায় তাদের শ্লোগানের বিষয়ে ‘আপত্তি’। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে মতামত জানানোর পরিকল্পনা করছে ধর্মকেন্দ্রিক একাধিক সংগঠন।

মাদ্রাসার শিক্ষক, সংগঠনের সঙ্গে আলাপ করলে জানায়, মাদ্রাসায় আলোচনা থাকে সাধারণত ধর্মীয় বিষয়ে। বক্তব্য শেষে স্রষ্টার নাম উচ্চারণে পূণ্যের বিষয়টিকে বড় করে দেখেন তারা। জয় বাংলা উচ্চারণে দেশপ্রেমের বিষয়টি তাদের মধ্যে অনেকের বিবেচনায় ‘গৌণ’। এর আগে মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর বিষয়টি আলোচনায় এলে শিক্ষকসহ ধর্মীয় সংগঠনগুলো বিরোধিতা করে। জাতীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার থাকায় তারা একে ‘হারাম’ বলে মনে করে।

অভিযোগ আছে, জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান করতে ২০২০ সালের মার্চে উচ্চ আদালত রায় দিলেও ‘মাদ্রাসা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বিরোধিতা’ বিবেচনায় সরকার এতোদিন তেমন উদ্যোগ নেয়নি। প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও শব্দ দুটি উচ্চারণে ‘অনাগ্রহী’। জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান করতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দাবি দীর্ঘ বছরের।

আদালতের রায়ের আগের মাসেও ক্ষমতাসীন দলের কয়েক সংসদ সদস্য এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নেওয়ার আহ্বান জানান তারা। ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ প্রসঙ্গে সরকারি দলের সংসদ সদস্য, পরে প্রয়াত আব্দুল মতিন খসরু সংসদে বলেন, ‘সরকারি অনেক কর্মকর্তা জয় বাংলা বলতে জড়তায় ভোগেন।’

অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষার নীতিতে ‘অবিচল’ থাকা জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুহাম্মাদ আলি সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে মত ও পথকে বলেন, ‘জয় বাংলাকে সরকারের জাতীয় শ্লোগান ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য তা বাধ্যতামূলক করতে যাওয়ার বিষয়ে এখনো আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সবাই বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী মত ও পথকে বলেন, ‘জয় বাংলা শ্লোগান ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। একে বাধ্যতামূলক করা হলে স্বাধীনতার প্রতি আমাদের দায় কিছুটা হলেও আদায় হবে। কওমি মাদ্রাসাসহ মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু সংগঠন এর বিরোধিতা করতে পারে। তাদের অতীত কর্মকাণ্ড এটা বলছে। স্বাধীনতাবিরোধি চক্রও এ নিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অপকৌশল করতে পারে।’

মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্রয়াত এইচ এম এরশাদের ‘আপত্তি’ ছিল জয় বাংলা শ্লোগানে। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমার সংসদ সদস্যরা (জাপার দলীয়) সংসদে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা বলে বক্তব্য শেষ করলে খুব কষ্ট পাই।’ এরশাদের মন্তব্য ও জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগানের বিষয়ে বক্তব্য জানতে জাপার শীর্ষপর্যায়ের চারজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে মত ও পথ। তারা কেউ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তথ্যমতে, ২০২১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সব মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপর বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা উলামা পরিষদের সভাপতি আব্দুল হামিদ দাবি করেন, ‘মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া সম্পূর্ণ শিরক (সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে কাউকে শরিক করা)। এতে দেশকে মা সম্ভোধন করা হয় হিন্দুদের দেবির মতো।’

কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রক সর্বোচ্চ বোর্ডের সদস্য ফয়জুল্লাহ মনে করেন, ‘কওমি মাদ্রাসায় কোরআন, হাদিসের শিক্ষা দেওয়া হয়। কোরআন, হাদিস সংগীত দিয়ে শুরু করা যায় না। আমরা সূরা ফাতেহা, বিসমিল্লাহর মাধ্যমে যে কোনো কাজ শুরু করি।’

প্রসঙ্গত, জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলার অনুমোদন দেওয়ায় সরকারের প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন নানা অঙ্গনের বরেণ্য ১৮ নাগরিক। তাঁরা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রাষ্ট্রপিতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। এরপর রাষ্ট্রীয় আচার থেকে নির্বাসিত ছিল জাতির প্রাণের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’। প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধের এ শ্লোগান আবারো রাষ্ট্রের শরীরে প্রতিস্থাপিত হলো।

শেয়ার করুন