মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাদায়ক জয় বাংলাকে সরকারের জাতীয় শ্লোগান করার সিদ্ধান্তে ‘চরম অস্বস্তি, বিব্রতকর পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হচ্ছে বিএনপি। দলীয় কোনো সভায় কখনো এ শ্লোগান উচ্চারণ করেনি দলটি। জয় বাংলাকে নিয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের কটূক্তি করা ও অনুষ্ঠানে তা না বলে তোপের মুখে পড়ার নজির আছে। জাতীয় শ্লোগানের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দলীয় অবস্থান কী হবে, তা নির্ধারণে শিগগির বৈঠকে বসার পরিকল্পনা করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অন্তত ছয়জনের সঙ্গে আলাপ করে মত ও পথ। তাঁরা বলেন, জয় বাংলাকে শ্লোগান হিসেবে ‘মানবে না’ বিএনপি। রাজনীতির মাঠে দলটিকে এ বিষয়ে ‘ঘায়েল, কোণঠাসা’ করতে চাইবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর কৌশল নির্ধারণেও পরিকল্পনা করছে সরকারবিরোধি দল বিএনপি।
প্রজ্ঞাপন জারি করে এ শ্লোগান উচ্চারণ বাধ্যতামূলক করলেও সরকারে না থাকায় দলটির শীর্ষ নেতাদেরকে তা ‘আপাতত’ বলতে হবে না বলে মনে করছেন তাঁরা। দলের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চালু করা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান সভা, সমাবেশ শেষে উচ্চারণের ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ আছে দলটির। এর সঙ্গে নতুন শ্লোগান যোগ করার বিষয়ে দলটি ‘ভাবছে না’।
জয় বাংলাকে প্রকাশ্যে বিরোধিতার বদলে চুপচাপ থাকার কৌশল নেবে বিএনপি। গত রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে একে জাতীয় শ্লোগান করার সরকারের সিদ্ধান্তের পর থেকে এখনো পর্যন্ত দলের কেউ সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরের দিন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরাসরি না হলেও ‘আক্রমণাত্মক বক্তব্য’ দেন। তিনি দাবি করেন, ‘আওয়ামী লীগের সরকার জয় বাংলা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।’
জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। আগামী ৭ মার্চের আগে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষ করেন জয় বাংলা বলে। ইতিহাসের বিষয়টি বিবেচনায় ৭ মার্চে প্রজ্ঞাপন জারির ভাবনা আছে সরকারের।
যোগাযোগ করলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গ মত ও পথকে বলেন, ‘জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান করার বিষয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নেই।’ এ বিষয়ে দলের বক্তব্য, বা অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলীয় ফোরামে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে গণমাধ্যমকে পরে জানানো হবে।’
প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও জয় বাংলাকে নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ‘কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্যের’ ভিডিও ভাইরাল হয় গত নভেম্বর মাসে। ইন্টারনেট থেকে ওই ভিডিও অপসারণের ব্যবস্থা নিতে গত ৮ ডিসেম্বর নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। সমালোচিত ওই ভিডিওর বক্তব্যের বিষয়ে আলাল, বা বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা গণমাধ্যমে দেওয়া হয়নি।
রাষ্ট্রীয় দিবস পালন, উদযাপনের অনুষ্ঠানেও বিএনপির নেতাদের জয় বাংলা বলার নজির নেই। এ শ্লোগান উচ্চারণ না করে তোপের মুখে পড়ার ঘটনা আছে। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলায় মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পড়েন বিএনপির নেতা ও সাবেক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সিরাজুল হক। বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর ওপর চড়াও হতে গেলে পরিস্থিতি শামাল দেন জেলা প্রশাসক।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জয় বাংলা সম্পর্কিত হলেও এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতা যোগ হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে বাদ পড়ে যায় জয় বাংলা। যোগ হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান দলীয় রাজনীতির বিভাজনের কবলে পড়ে। তবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ দলীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে জয় বাংলা ব্যবহার করে।