মাতৃভাষার প্রতি গভীর আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা না থাকলে সে জাতির টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন! বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তবে কেন ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পরও ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে? সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার যে জাতীয় অঙ্গীকারের কথা আমরা প্রায়ই বলা হয় তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? এটা নিয়ে ভাবতে হবে যে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি কী। কেন জানি মনে হচ্ছে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের অনাদরের শিকার হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। শিক্ষিত জনগণের একটি বড় অংশ কেন জানি চায় শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হোক! আজ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। চারদিকে ইংরেজিতে লেখা পোস্টার-ব্যানারের জয়জয়কার। ক্রিকেটের বিভিন্ন দল বা ক্লাবের নাম রাখা হচ্ছে ইংরেজিতে। সর্বোপরি মাতৃভাষার অনাদারের ফলে শিক্ষার মান নিয়েও এখন আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। স্কুল-কলেজগুলোতে ভালো করে না শেখানো হচ্ছে বাংলা, না শেখানো হচ্ছে ইংরেজি। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এখন ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পৃথিবীতে মাত্র ৪০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। অথচ এ ভাষার প্রতি কতই না গুরুত্ব! ধার করা ভাষায় আর যাই হোক পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া কঠিন!
নদীর ওপারেতে বেশি সুখ খোঁজার মতো মাতৃভাষা বাংলা সঠিকভাবে আয়ত্ত না করে ইংরেজির প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ কোনো ফল বয়ে আনতে পারে না! এখন আমরা না বুঝে বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার তুলনা করছি। ছোটবেলা থেকে সন্তানকে ইংরেজি শেখানোর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। সর্বোপরি বাংলা ভাষার প্রতি রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও ব্যক্তিক অবহেলা বাড়ছে! ‘ভালো বাংলা বলতে পারি না’- এটা বলতে পারাটাও যেন এক ধরনের যোগ্যতা হয়ে গেছে! সর্বোচ্চ আদালতে এখনো রায় লেখা হয় ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিতে। ইংরেজির আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষার প্রতি দরদ লক্ষ করা যায়, বাকি সময় ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আর কোনো আলোচনা হয় না! যে ভাষার জন্য অকাতরে রক্ত বিলিয়ে দিতে হয়েছে, সেই মাতৃভাষার প্রতি কি আমাদের দায়বদ্ধতা নেই? স্বাধীনতার পর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল, সেগুলো পরবর্তীতে আর এগিয়ে নেয়া হয়নি কেন, সে ব্যাপারে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
শিশু বয়স থেকে শিক্ষার্থীর বাংলা ভাষার শোনা-বলা-পড়া-লেখা দক্ষতার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। যেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে বাংলা। বাঙালির তথা বাংলাভাষার বইমেলা আজ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ হচ্ছে। মানুষের মতো মানুষ হতে চাইলে সবার আগে চাই মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ জ্ঞান। মনের বিকাশ, নৈতিক চেতনার বিকাশ একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। একুশের চেতনা ও মর্যাদাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য অন্য সবার সঙ্গে লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে চলেছেন। বই দেশ গড়া ও জাতি গড়ার প্রথম ও প্রধান উপাদান। বই-ই পারে সব সংশয় থেকে আলোর পথের সন্ধান দিতে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে পড়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর দিনের বিশাল একটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বসে থেকে কতটা সামাজিকতার বিকাশ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে! এ ব্যাপারে পরিবারের মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে। তরুণ শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। অবসর সময়ে বই-ই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এখন থেকেই যদি প্রত্যেক পরিবারে ঘরের কোনো একটি কোণে লাইব্রেরি গড়ে তোলা যায় তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ভাষা ও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আরো দৃঢ় হবে।
সাধন সরকার : শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ।