কাদের নির্দেশে বাসসে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাংবাদিক আবুল মকসুদ?

হাসান শান্তনু

ফাইল ছবি

সাংবাদিক, লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার’ (বাসস) শীর্ষ পদ থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বহুমাত্রিক লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর নৃশংস হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রিত বাসসে কর্মরত থাকলে কোনোভাবে জোট সরকারের সমালোচনা করা যাবে না, এ শর্ত দেওয়া হয় তাঁকে।

সাংবাদিকদের সত্য লেখার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দিক বিবেচনায় গবেষক আবুল মকসুদ চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। জোট সরকারের কারা সেদিন এ নির্দেশ দেন, বিষয়টি অনেকটা অনালোচিত রয়ে গেছে। ২০০৪ সালের ৩ মার্চে কর্তৃপক্ষকে দেওয়া তাঁর পদত্যাগ পত্রে ‘উপরের নির্দেশ’ বা জোট সরকারের শীর্ষপর্যায়ের প্রসঙ্গটির উল্লেখ আছে। পদত্যাগের আগে তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে বাসসের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতরভাবে আহত করে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আবুল মকসুদ কলাম লেখেন দৈনিক প্রথম আলোতে। এর শিরোনাম ছিল ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত: ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’।

এ লেখা কেন্দ্র করে আবুল মকসুদের প্রতি চাপ আসে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে। বাসসের ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক তাঁকে ‘সরকারি নির্দেশের’ কথা জানিয়ে বলেন, বাসসে চাকরি করলে অন্য কোনো পত্রিকায় কলাম লিখতে পারবেন না। এ বিষয়ে সেদিন কোনো আপস না করে সাংবাদিকতায় সাহসের অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

বাসসের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি কখনো প্রচারণায় আনেননি পাঠকপ্রিয় লেখক আবুল মকসুদ। ঢাকার সাংবাদিক সমাজের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। কোন পরিস্থিতিতে বাসসের চাকরি তিনি ছাড়তে বাধ্য হন, জোট সরকারের কাদের নির্দেশ ছিল, এ বিষয়ে সাংবাদিক সমাজের জানা আছে। প্রচলিত আছে, নির্দেশ আসে ওই সময়ের বিতর্কিত হাওয়া ভবন থেকে, যার নিয়ন্ত্রক ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তিনি এখন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

হাওয়া ভবন সেদিন নির্দেশ পাঠায় আলবদর নেতা ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরামর্শে। ওই সময়ের তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামও বাসসের শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে একই নির্দেশ দেন। নৃশংস আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে ড. হুমায়ুন আজাদের লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদসংখ্যায়। শিরোনাম- ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। যা পরে নামকরা প্রকাশনা সংস্থা আগামী থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

ক্ষমতায় এসে জামায়াত, দলটির ছাত্র সংগঠন শিবিরের সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী ধর্ষণের কথা উঠে আসে ওই উপন্যাসে। জামায়াত নেতা সাঈদী একাধিক ওয়াজ-মাহফিল, বক্তৃতায় দাবি করেন- ওই লেখায় হুমায়ুন আজাদ ইসলাম ধর্ম, কোরআানকে ‘বিকৃত’ করেছেন। যা আদৌ সত্য নয়। হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলার জন্য সাঈদীর উস্কানিকে বিশেষভাবে দায়ি করা হয়। অভিযোগ আছে, মরণোত্তর দেহদানের কথা বলে গেলেও অধ্যাপক আজাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রাখেনি সাঈদীর নির্দেশে।

২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিরীহ মানুষ হত্যা করলে সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রতিবাদ করেন অভিনব উপায়ে। তিনি শপথ নেন, যতোদিন ইরাকে আগ্রাসী বাহিনী থাকবে, ততোদিন পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত সেলাই করা কাপড় পরবেন না। সেই থেকে সেলাইবিহীন ধবধবে সাদা কাপড় পরতেন তিনি। এ বিষয়েও কটূক্তি করেন বিএনপি-জামায়াতের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও সংসদ সদস্য। বিষয়টি দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কলামিস্ট সোহবার হাসান এক লেখায় উল্লেখ করেছেন।

তিনি লেখেন, ‘ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্র হামলা করে, তখন বাংলাদেশে বিএনপির শাসনকাল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা সৈয়দ মকসুদের এ ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ পছন্দ করেননি। এর মধ্যে তিনি দু-একটা পত্রিকায় কলামও লিখতেন। সরকার থেকে চাপ দেওয়া হলো তিনি যেন লেখালেখি বন্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনি বাসস থেকে চাকরি ছেড়ে দিলেন।’

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম ২০১৮ সালে মারা গেছেন। আবুল মকসুদের আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

হুমায়ুন আজাদকে হত্যা চেষ্টায় বর্বরোচিত হামলার আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে এর বিচার হয়নি। তবে তাঁকে হত্যা চেষ্টা মামলার বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে বলে জানা যায়।

শেয়ার করুন