দ্রব্যমূল্যের বাস্তবায়তায় গণমাধ্যমকর্মীদের ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

ইদানীং হু হু করে বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এ দেশের অতিপরিচিত এক রূপ। করোনা মহামারি আসার পর পুরো বিশ্বেই স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে, তবে এই হার যেন বাংলাদেশে আকাশচুম্বী। কয়েক মাস ধরেই ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। বর্তমানে এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না, যার দাম বৃদ্ধি পায়নি। নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির বাজারে অনেক সাংবাদিককে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টেনেটুনেও চলছে না তাদের সংসার। প্রতিদিনের কঠিন এ বাস্তবতার কথা বলতে পারছেন না অনেকে ‘সামাজিক লজ্জায়’।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাপস রায়হান এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাস্তবায়তায় ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা গণমাধ্যমকর্মীদের। বিশেষ করে, যারা সংবাদ উৎস বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। তবে দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইনে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে শ্রেণিভেদ রয়েছে। প্রায় সময় সামান্য বেতনে তাদের কাছ থেকে, ঈর্ষণীয় বা ক্রিয়েটিভ কিছু প্রত্যাশা করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থা তারুণ্যের বহুমাত্রিক চাহিদার হঠাৎ প্রলোভনের পেশা সাংবাদিকতায় এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। ফলে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র গণমাধ্যম কর্মীরা হচ্ছেন অবহেলিত।’

universel cardiac hospital

তিনি বলেন, ‘অল্প মজুরিতে তারুণ্যের মেধাকে পূুঁজি করে বেশ‌ কিছু মিডিয়ার মালিক, তাদের অবৈধ বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে উঠছেন। অস্থির তারুণ্যের একটা গোষ্ঠীকে সেই তারাই সচেতনভাবে ঠেলে দিচ্ছেন অবৈধ পথে। যার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন মেধাবি, আদর্শিক, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনেক গণমাধ্যমকর্মী। দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে যে সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন, মাস শেষে তার
‘নিত্যভিক্ষা তনুরক্ষা’ অবস্থা।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) নির্বাহী পরিষদের সদস্য জুবায়ের রহমান চৌধুরী ‘মত ও পথকে’ বলেন, করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই নিত্যনতুন গণমাধ্যম প্রচার ও প্রকাশে আসছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নতুন আসা গণমাধ্যমগুলোতে প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম জনবল নিয়োগ দিচ্ছে। আবার নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের বেতন কাঠামোও অত্যন্ত কম।’

তরুণ এ সাংবাদিক নেতা আরো বলেন, ‘এই সময়ে সমাজের দর্পণ’ খ্যাত সাংবাদিকরা ভালো নেই। একদিকে যেমন বেকারত্ব বাড়ছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের চড়াদামে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। নিম্ন বেতন কাঠামোয় কোনো রকমে জীবন চলছে তাদের। ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’র রক্ষক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারিভাবে তাদের রেশনিং ব্যবস্থায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি।’

দৈনিক আজকের সংবাদের চিফ রিপোর্টার আবুল হোসেন বলেন, ‘ভরা মৌসুমেও চালের দাম , ডালের দাম বাড়তি । ভোজ্য তেলের দাম আকাশমুখি । নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন চলছে গাড়ি চলেনা চলেনা রে—এর মতন । কম বেতনের সাংবাদিকদের অবস্থা আরো ত্রাহি। না পারে কইতে , না পারে সইতে। এর কাছে , ওর কাছে চেয়ে , টেনেটুনে , দেনায় চালিয়ে নিচ্ছে সংসার। সাংবাদিকদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে , চিকিৎসা , সন্তানদের শিক্ষার জন্য বিশেষ সুবিধা বিমা চালু করতে হবে। রেশন সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।’

সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এমদাদুল হক তুহিন বলেন, ‘যে রেঞ্জের (৫০ হাজার টাকা) কথা বলা হচ্ছে, গণমাধ্যমের অনেক কর্মীরই বেতন—এর চেয়ে কম। সম্পাদক কিংবা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হাতে গোনা কয়েকজনের বেতন হয়ে থাকে জনপ্রতি কয়েক লাখের উপরেও। সেইসঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও অফিসের গাড়ি আছে। একেবারে নতুন কিংবা তরুণ অথবা মাঝবয়সী সাংবাদিকরাই থাকেন করুণ দশায়। সততার সঙ্গে কাজ করতে চাইলে সাংবাদিকতায়ও সৎ হতে হয়। উদ্যোম নিয়েই কাজ করতে হয়। অল্প বেতনেও ভালো থাকা যায় যদি সত্যিকার অর্থেই সাংবাদিকতায় সৎ থাকা যায়।’

তাঁর মতে, ‘সেক্ষেত্রে ভালো সাংবাদিকতা দিয়ে দেশি বিদেশি নানা কর্মশালা, ফেলোশিপ কিংবা পুরস্কার প্রাপ্তির দিকে ঝুঁকতে হয়। হাতেগোনা কয়েকজন বাদে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এটিই সম্ভব হয়ে উঠেনা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, গণমাধ্যম গণমানুষের। গণমুখী করেই তা থেকে ব্যবসা করতে হবে। আর তা করতে হলে জনমুখী সাংবাদিকতা প্রয়োজন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাংবাদিকদের রুটি রুজির বাস্তবিক ব্যবস্থা যেমন সম্ভব তেমনি শত কষ্টেও প্রকৃত সাংবাদিকতাকেও লালন করা সম্ভব।’

নিউজবাংলা২৪.কমের সিলেট ব্যুরো প্রধান দেবাশীষ দেবু বলেন, ‘যারা রিকশা চালান, যারা শ্রমিক তাদেরও সংসার চলছে তো। তাদের আয় নিশ্চয়ই ৫০ হাজার টাকা নয়। বলা হচ্ছে মধ্যবিত্ত যে জীবন যাপনে অভ্যস্ত, তা এই আয়ে চলছে না।
সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ তো সবসময়ই এই টানাপোড়নের মধ্যে ছিলেন। এখন দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারনে সেটা আরও বেড়েছে। অনেককিছু ছাড় দিয়ে, অনেক ব্যয় কাটছাট করে করে তাদের চলতে হচ্ছে। ফলে তারা মধ্যবিত্তের মানসিকতা ধারন করেন, মধ্যবিত্তের খোলসে থাকেন, এই সামাজিক অবস্থানও ধরে রাখতে চান, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তারা দরিদ্র। দিনদিন আরও দরিদ্র হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘এখন করণীয় একটাই। বেতন বাড়ানো। ওয়েজ বোর্ড নিশ্চিত করা। কিন্তু ওয়েজ বোর্ড দূরে থাক বেশিরভাগ সাংবাদিক এখন পর্যন্ত ন্যূনতম বেতনে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। নিয়মিত ইনক্রিমেন্টও পান না।’

কথাশিল্পী, সাংবাদিক রনি রেজা বলেন, ‘শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নয়, কখনোই দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে চলার মতো বেতনের সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি ছিল না। এই যে বিশাল সংখ্যক সাংবাদিক খুবই অল্প বেতনে চকারি করছেন তারা সবাই কষ্টে নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানে ঠিকঠাক বেতনই হয় না। সেখানেও কর্মী আছে। তাদের নানা কায়দায় উপার্জন আছে, হয়তো এজন্যই এই ‘বিনা বেতন’ বা অল্প বেতনেও চাকরি করছেন। তাদের একটা পরিচয়পত্র হলেই হয়। এই গোষ্ঠী না থাকলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হতো প্রাপ্য সম্মান ও বেতন দিয়ে সাংবাদিক রাখতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক সাংবাদিক বাধ্য হয়েই অল্প বেতনের চাকরি করছে। কষ্টে আছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে সাংবাদিক সমাজকে একটা নীতির মধ্যে আসতে হবে। সেটা হতে পারে নির্ধারিত যোগ্যতার ভিত্তিতে সাংবাদিক নিবন্ধন করা। এই নিবন্ধিত সাংবাদিকরাই কেবল বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ বিষয়ক কাজ করবেন। এবং এদের নির্ধারিত বেতনভাতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা স্পষ্টভাবে জানি- কোন কোন গণমাধ্যম হাউজ ঠিকমতো বেতন দেয় না বা কম বেতনে কর্মী ঠকায়, তারপরও সংগঠনগুলো কোনো উদ্যোগ নেয় না। দেখা যায় ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীকেই (যাদের বিরুদ্ধে মালিক পক্ষের হয়ে কর্মীর বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে) তাদেরকে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতা হিসেবে জয়ী করি। তাই বলাই যায়- সমস্যার শেকড় শক্তভাবে গেড়ে বসেছে। পরিকল্পিত সমাধান দরকার, এজন্য সর্ব প্রথম সাংবাদিকদেরই আন্তরিক হতে হবে।’

শেয়ার করুন