ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঝড় বইয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর মিত্ররা। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল্য লক্ষ্য রুশ প্রতিষ্ঠানগুলোতে মার্কিন ডলার প্রবাহ বন্ধ করা এবং দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, জ্বালানি রপ্তানি ও আর্থিক খাতের ক্ষতিসাধন করা। তবে পশ্চিমাদের একজোট হয়ে দেওয়া এই নিষেধাজ্ঞার ঢেউ রাশিয়াকে চীনের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিমারা আগে কখনোই বিশ্ববাণিজ্য থেকে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে একঘরে করার চেষ্টা করেনি। তাদের এবারের উদ্যোগ মস্কোর ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা হালকা কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই সাবেক সোভিয়েত দেশটির প্রধান রপ্তানি গন্তব্য হয়ে ওঠে চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাণিজ্য আলোচক ও বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা হ্যারি ব্রডম্যানের মতে, নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে উদ্যোগী হতে পারে মস্কো। তিনি বলেন, এই নিষেধাজ্ঞার সমস্যা হচ্ছে, রাশিয়ার মতো তেল উৎপাদকের সংশ্লিষ্টতা। এটিই গোটা ব্যবস্থার গলদ হয়ে উঠতে পারে।
গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সই করা নির্বাহী আদেশে রাশিয়ার আর্থিক খাত লক্ষ্য করে বড় নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, রাশিয়ার দৈনিক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ৮০ ভাগ ও বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেকটাই সম্পন্ন হয় মার্কিন ডলারে। বাইডেন বলেছেন, তিনি রুশ অর্থনীতিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার যন্ত্রণা বোঝাতে শক্ত পদক্ষেপ নেবেন। তবে তার এই কথা বলা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন তার চেয়ে অনেকটাই কঠিন হবে।
তেল, গ্যাস, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়ামসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক রাশিয়া। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার খবর ছড়ানোর পরপরই মঙ্গলবার অপরিশোধিত তেলের দাম এমন উচ্চতায় পৌঁছায়, যা ২০১৪ সালের পর আর দেখা যায়নি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ১ দশমিক ৯ শতাংশ অবদান ছিল রাশিয়ার। অবশ্য ২০১৩ সালে এর হার ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে জিডিপির হিসাবে তাদের অবস্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে ১১তম।
বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সলিউশন ডেটাবেসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০ বছরে রাশিয়ার বাণিজ্যনির্ভরতা অনেকটাই কমে গেছে। এসময়ে তাদের রপ্তানি গন্তব্যও বদলেছে।
এক দশক আগেও তেল বাণিজ্যের কারণে রাশিয়ার এক নম্বর রপ্তানি গন্তব্য ছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু সেই জায়গা এখন চীনের দখলে। রাশিয়া থেকে জার্মানি-যুক্তরাজ্যের পণ্য আমদানি অনেকটা স্থিতিশীল ছিল, তবে বেলারুশের আমদানি বেড়েছে।
রাশিয়ার পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও অন্যতম প্রধান পণ্য সরবরাহকারী চীন। সাবেক সোভিয়েত দেশটিতে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টেলিযোগাযোগ যন্ত্রাংশ, খেলনা, টেক্সটাইল, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ প্রভৃতি রপ্তানি করে বেইজিং।
২০১৪ সালের পর রাশিয়া থেকে চীনের পণ্য আমদানি বাড়তে দেখা গেছে, যেখানে জার্মানি থেকে চীনাদের আমদানি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গত এক দশকে ইউক্রেন থেকে চীনের আমদানি কমেছে ব্যাপকভাবে, তবে বেলারুশের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই।
রাশিয়া-ইউক্রেনে চলমান সংকটে বেশ সাবধানী ভূমিকা পালন করছে বেইজিং। লুহানস্ক-দোনেৎস্ককে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ায় এরই মধ্যে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। তবে চীন বলছে, নিষেধাজ্ঞা এই সংকটের সমাধান নয়। সব পক্ষকে সংযমী থেকে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
সূত্র: রয়টার্স