নিত্যপণ্যের আকাশ ছেদক দামের বাজারে সংসার চালানো দায় ঢাকার অনেক সাংবাদিকের। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সামাজিক মর্যাদায় তারা আগে ‘মধ্যবিত্ত সমাজের কাতারে’ থাকতে চাইতেন। শুধু মধ্যবিত্ত নয়, আয়ের হিসাবে ও নিত্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে অনেক সাংবাদিকের নিম্নবিত্তের তালিকায় থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। নিত্যদিনের চাহিদায় প্রয়োজনীয় নানা কিছু বাদ দিয়ে তারা নিম্নবিত্তের মতোও সংসার চালাতে পারছেন না। বাজারে কোনো কিছুর দাম এখন আয়ের নিরিখে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সাধ্যের নাগালে নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝামাঝি ‘উপমধ্যবিত্তের’ একটা শ্রেণিতে থাকার চেষ্টা করছেন অনেক সাংবাদিক। বেতন বা মাসিক আয় কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা না হলে সামাজিক জীবনে ওই শ্রেণিতে থাকা এখন আর সম্ভব নয়। অনেকের বেতন ওই অংকের নিচে। টিভি চ্যানেল, দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকা, বেতার, অনলাইন পোর্টাল আর দৈনিক ও টিভি চ্যানেলগুলোর অনলাইন মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকার নিচে বেতন পাওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি। মাস অর্ধেক হওয়ার আগেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের। টানাপোড়েন লেগে থাকছে সংসারে। এ পরিস্থিতিতে নির্মোহ, সৎ সাংবাদিকতার চর্চা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কারো নিয়ন্ত্রণ বাজারে আছে কী না, তা দৃশ্যমান নয়। প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, সবজি, পেঁয়াজ—সব কিছুর দাম বাড়তি। এর প্রভাবে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। সাংবাদিক সমাজের একটা অংশও এর বাইরে নয়। মত ও পথ গত দশদিনে ঢাকায় কর্মরত তিন শতাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে তাদের সংসার জীবনে নাভিশ্বাসের চিত্র উঠে এসেছে। ‘সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনায় ও লজ্জাকর পরিস্থিতি এড়াতে’ তাদের মধ্যে বেশিরভাগ সাংবাদিক নাম প্রকাশে রাজি হননি। তবে এটা রাজধানীর গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িতদের পুরো চিত্র নয়।
গত কয়েক বছরে সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সাংবাদিকতায় এখন সুযোগ-সুবিধা বেশি। এ পেশার প্রতি নতুন প্রজন্মের আকর্ষণ বাড়ছে। মত ও পথের পর্যালোচনা বলছে, দেশের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো পড়েছে তিনটি সংকটের কবলে। এক. তথ্যের মহামারি, দুই. স্বাস্থ্যের অতিমারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, তিন. প্রযুক্তির দাপট। করোনা সংক্রমণের পর দেশ-বিদেশের রাজনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসে। অনেক কিছুই থমকে দেয় করোনা। এর সঙ্গে মাথার উপর ঝুলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ।
একঘেয়ে লেখা ও প্রতিবেদন পাঠক, দর্শক পছন্দ করছেন না। অনুসন্ধানী, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংবাদের অভাবে পাঠক, দর্শকপ্রিয়তা হারাচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল। বিজ্ঞাপন দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান মালিকরা। কমছে সংবাদমাধ্যমের আয়। এ কারণে গত বছর প্রথম সারির প্রায় তিনটি জাতীয় দৈনিক ছাঁটাই করে জনবল কমিয়েছে।
নানা সংকটের মধ্যে পথচলায় অভ্যস্ত দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট পার হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছে প্রচারমাধ্যম, আগে থেকে একে মোকাবেলার প্রস্তুতি অনেকের ছিল না। এ সংকট শুরু হয় কয়েক বছর আগে।
ফেসবুক, ইউটিউব জনপ্রিয় হওয়ায় বিজ্ঞাপন দাতারা ঝুঁকে পড়ছেন সেদিকে। এতে ছোট হয়ে যায় বিজ্ঞাপনের বাজার। বিদ্যমান বাজারের বিজ্ঞাপনের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, বিদেশি গণমাধ্যমে। দেশি গণমাধ্যমের আয়ে টান পড়ছে। টানাটানির সংসারে আঘাত হানে করোনা। প্রযুক্তির দাপটে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে যে সংকট ঘনীভূত হচ্ছিল, করোনা এসে তাকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। এর ধকল পোহাতে হচ্ছে সাংবাদিক সমাজকে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাপস রায়হান মত ও পথকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের বাস্তবায়তায় ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা গণমাধ্যমকর্মীদের। বিশেষ করে, যারা সংবাদ উৎস বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের। তবে দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইনে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে এ ব্যাপারে শ্রেণিভেদ রয়েছে।’
সাংবাদিক জুবায়ের রহমান চৌধুরী বলেন, ‘করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গড়ে প্রায় প্রতি মাসেই নতুন গণমাধ্যম প্রচার ও প্রকাশে আসছে। নতুন আসা গণমাধ্যমগুলো প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম জনবল নিয়োগ দিচ্ছে। আবার নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের বেতন কাঠামোও অত্যন্ত কম।’
সাংবাদিক রনি রেজা বলেন, ‘শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নয়, কখনোই দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে চলার মতো বেতনের সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি ছিল না। খুব অল্প বেতনে চাকরি করলেও সব সাংবাদিক কষ্টে নেই।’
তথ্য বলছে, ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলো সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন সরকারের নির্ধারিত নবম রোয়েদাদ বোর্ড অনুসরণ করার কথা। সরকার চাইলেও মালিকপক্ষের ‘কিছু বিরোধিতার’ কারণে এর বাস্তবায়ন হয়নি। পত্রিকাগুলো অষ্টম মজুরি বোর্ড অনুসরণ করছে। যা ২০১৩ সালে ঘোষণা করে সরকার। এতে বেতন বাড়ার পরিমাণ ছিল ৭৫ শতাংশ। সব পত্রিকায় সমানভাবে এর বাস্তবায়ন নেই।
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (নোয়াব) ‘নবম মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়’ বলে মত প্রকাশ করে। সংগঠনটির ভাষ্য, সংবাদপত্রের মালিকরা সব সময় সাংবাদিক, কর্মীদের আর্থিক সুরক্ষা, বেতন-ভাতা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। বর্তমানে সংবাদপত্রশিল্প অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে নবম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ডের বাস্তবায়ন হলে সংকট বাড়বে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নোয়াবের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভায় বলা হয়, ‘করোনাকালে সংবাদপত্র শিল্প সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা পায়নি। নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দেড় বছর আগে প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল যেখানে ৫৭০ ডলার, এখন তা ৮৯০ ডলার। করোনাকালে বিজ্ঞাপনের বাজার ৫৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। সংবাদপত্রশিল্প একটি সেবাশিল্প। শিল্পটি রুগ্ন। এরপরও সহায়তা পাচ্ছে না।’ তবে করোনালে ঢাকা ও এর বাইরের অনেক সাংবাদিক আর্থিক সহযোগিতা পান সরকারের ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ট্রাস্টে অনুদান দেন।