ইউক্রেনের পর জর্জিয়া, মলদোভায় আক্রমণ করবে রাশিয়া?

হাসান শান্তনু

ইউক্রেনের সামরিক সদর দপ্তরে হামলা
ছবি : ইন্টারনেট

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশে সবচেয়ে বড় হামলা। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু এ হামলায় ‘যে কোনো মুহূর্তে’ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন হতে পারে বলে আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের। বৈশ্বিক কূটনীতি সমঝোতায় আসতে না পারলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়ে উঠতে পারেন ‘অপ্রতিরোধ্য’! তিনি হয়ে উঠতে পারেন চলতি দশকের ‘যুদ্ধবাজ নেতা’। ইউক্রেনের পর তিনি হামলা চালাতে পারেন জর্জিয়া, মলদোভা বা অন্য কোনো দেশে।

জর্জিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যপদ নেওয়ার বিষয়ে রাশিয়ার ‘আপত্তি’ আছে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, এর মিত্রদের গত তিন দশকের কৌশল ইউরোপের ‘সংঘাতকে প্রায় অনিবার্য’ করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশিল্পের স্বার্থে। কোনো ‘আপত্তি, অজুহাত’ সার্বভৌম একটি দেশে অন্যদেশের হামলাকে ‘যৌক্তিক’ করে তুলতে পারে না। তবুও জর্জিয়া, বা অন্য কোনো দেশে হামলা চালানোর আগে বিদ্যমান এসব ‘বাস্তবতাকে’ সামনে আনতে পারে রাশিয়া।

universel cardiac hospital

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্যাক ম্যাটলক গত বছরের আগস্টে আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, শীতল যুদ্ধের পরে ন্যাটোর সম্প্রসারণ না ঘটলে ইউরোপের এখনকার সঙ্কটের কোনো ‘ভিত্তি’ থাকত না। এ ‘ভিত্তি’ কেন্দ্র করে ইউক্রেনের পর জর্জিয়া, মলদোভায় রাশিয়া হামলা চালায় কী না, এখনই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন একই কথা বলছে। যুক্তরাজ্যসহ আরো কয়েকটি দেশও বলছে, ইউক্রেনেই থামছেন না পুতিন। এর মধ্যে জো বাইডেন ইউরোপের ন্যাটো জোটভুক্ত কয়েকটি দেশে মার্কিন সেনাদল পাঠাচ্ছেন। বিশেষ করে, ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকা দেশগুলোতে।

রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে এতোদিন ‘হুঁশিয়ারি’ উচ্চারণ করে এলেও ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী দেশ না হওয়া, দেশটিতে নিজ দেশের সামরিক ঘাঁটি ও বিশাল তেলের মওজুদ না থাকায় সেখানে সংঘর্ষে জড়াবে না যুক্তরাষ্ট্র। পুতিনের তাই ‘যুদ্ধবাজি’ আরো উস্কে উঠতে পারে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ন্যাটো। জার্মান সংবাদপত্র ‘ডের স্পিগেল’ এ বিষয়ে একটি নথি প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশকে সদস্য করবে না। দুই জার্মানির একত্রিত হওয়া বা বার্লিন দেয়াল ভাঙ্গনের সময়ে ১৯৯১ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের সভার সিদ্ধান্তও রক্ষা হয়নি।

তখন সিদ্ধান্ত হয়, জার্মানির এলবে নদীর পরে ন্যাটোর আর প্রসার হবে না। পোল্যান্ডকেও ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে একের পর এক দেশকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করে ন্যাটো। পুতিন মনে করেন, রাশিয়াকে চারদিক থেকে ‘ঘিরে ধরতে’ পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকেও এ উদ্দেশ্যে ন্যাটোতে নেওয়া হতে পারে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে আসছেন তিনি।

রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে ‘নিশ্চয়তা’ চায়, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয় ন্যাটো ও পশ্চিমা দেশগুলো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা স্টিফেন ওয়াল্ট বিবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এ রকম নিশ্চয়তা দিতে চাইছে না। এর কোনো মানে হয় না। কারণ, তারা তো সামরিক শক্তি নিয়ে ইউক্রেনের পক্ষেও দাঁড়াচ্ছেও না।’

সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পতনের’ পর ন্যাটোর এভাবে সম্প্রসারণের পেছনের অন্যতম কারণ মার্কিন অস্ত্র শিল্পের বিকাশ ঘটানো। লকহিড মার্টিনের মতো অস্ত্র নির্মাতারা সাবেক ওয়ারশ জোটের দেশগুলোকে নতুন ক্রেতা হিসেবে বিবেচনা করায় তারা ন্যাটোর নেতাদেরকে দিয়ে একের পর এক সদস্যপদ দেওয়াতে থাকেন।

বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ জর্জ এফ কেনান ১৯৯৭ সালে সতর্ক করেন, ‘শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন নীতির সবচেয়ে মারাত্মক ভ্রান্তি হবে ন্যাটোর সম্প্রসারণ।’ তাতে কান দেওয়া হয়নি। এখন বাইডেন প্রশাসন বলছে, ইউক্রেনের পর পুতিনের আরো কী বড় পরিকল্পনা আছে, এ বিষয়ে ন্যাটোর কয়েকটি দেশ বেশ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান দেশগুলোর সেই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে পুতিন ন্যাটোর কোনো দেশে আক্রমণ চালালে সেখানে জড়াবে বাইডেন প্রশাসন।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের কণ্ঠেও উদ্বেগ। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘ইউক্রেনের পর হয়তো রাশিয়া থামবে না। পুতিন বিচারশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি নন। বাল্টিক দেশগুলো যে একেকটি আলাদা দেশ, তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তার বিরুদ্ধে আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে।’

জর্জিয়া, মলদোভা, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। রাশিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের সুবিধা, তিনটি দেশেই রুশপন্থী বিদ্রোহী আছেন। সেজন্য ইউক্রেনে হামলার পর পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে জর্জিয়া, মলদোভার নাম আসছে।

লেখক : সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন