আওয়ামী লীগে ‘আমলানির্ভরতা’ কী বাড়ছে?

হাসান শান্তনু

আওয়ামী লীগ
ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগ ‘আমলানির্ভর’ হয়ে পড়ছে বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে। দিনে দিনে এ ‘নির্ভরতা’ বাড়ছে বলে তাদের অভিযোগ। দলটির নেতৃত্বের সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দলীয় নেতাদের বদলে আমলারা দায়িত্ব পাচ্ছেন। সরকারের ‘আমলাঘেঁষা’ নীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষপর্যায়ের কয়েক নেতার মধ্যে ‘ক্ষোভ’ আছে। প্রকাশ্যে অভিযোগও করেন তাঁরা। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনকে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া নিয়েও দলের কারো কারো মধ্যে আলোচনা আছে।

সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ‘আমলানির্ভর’ বলেছেন আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত একাধিক বিশিষ্ট নাগরিক। জাতীয় সংসদের বিরোধিদল জাতীয় পার্টিরও (জাপা) একই মন্তব্য। ‘আওয়ামী লীগের সমর্থিত আমলানির্ভর ইসি’ বলে ‘প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া’ দলটির। বিষয়টি কেন্দ্র করে ‘আমলানির্ভরতার’ প্রসঙ্গটি আবার সামনে আসছে। গত বছরের জুনে ও চলতি বছরের শুরুতে সরকারের ‘আমলানির্ভরতার’ সমালোচনা জাতীয় সংসদে করেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য। ‘আমলানির্ভরতা’ দলকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কী না, সেই প্রশ্নও কারো কারো। চলতি বছর দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ও আগামী বছর অনুষ্ঠেয় পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে বিষয়টি তাই আওয়ামী লীগের কোনো কোনো ঘরোয়া আলোচনায় মাঝেমধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে।

universel cardiac hospital

গত জানুয়ারি মাসে ‘আমলাতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে’ সব সংসদ সদস্যকে সোচ্চার হওয়ার আহবান’ জানান সরকার দলীয় প্রবীণ সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। গত জুন মাসে ‘আমলাদের বাড়াবাড়ি’ নিয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে ‌’না জানিয়ে’ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় বলে তিনি প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন। গত বছর বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ব্যানার অপসারণ কেন্দ্র করে ঘটনা রূপ নেয় বরিশাল সিটি মেয়র বনাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাতে (ইউএনও)।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে গতকাল রোববার রাতে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মত ও পথের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নেওয়া মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় আমলাদেরকে ‘প্রাধান্য’ নিয়ে দলের কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও অনেকে ‘আমলানির্ভরতা’ হিসেবে দেখেন। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো ‘আমলানির্ভরতা’ নেই।

তাঁরা বলেন, অনুসন্ধান কমিটির কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তির প্রস্তাবিত নামের তালিকায় আমলাদের প্রাধান্য ছিল। ইসি, অনুসন্ধান কমিটির বিষয়গুলো আওয়ামী লীগের নয়। যে কোনো দেশে সরকারের কাজ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সেটি বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকেন আমলারা। রাজনৈতিক দল ও সরকার আলাদা বিষয়। বিষয়টিকে ‘আমলানির্ভরতা’ হিসেবে সবসময় অভিযোগ করা যৌক্তিক নয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সব দেশে রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। করোনা ছড়ানোর আগে যেভাবে দলীয় কর্মসূচি থাকতো, করোনার পর কোনো দেশে তা আগের মতো নেই। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে চলতি বছরের শুরু থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

দল ও সহযোগী সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে দল। করোনার কারণে প্রায় দুই বছর পরিকল্পনা অনুযায়ী দল গোছানোর যেসব কাজ করা সম্ভব হয়নি, সেগুলো করতে দলের আটটি বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। দল, সরকার সম্পর্কে অপপ্রচারের জবাব দিতে ও উন্নয়ন প্রচারে মাঠে নামার সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। ভিন্ন শক্তির ওপর নির্ভরশীল কোনো রাজনৈতিক দলের এমন কর্মসূচি থাকে না। ক্ষমতার জন্য তারা ওই শক্তির উপর নির্ভর করে। আওয়ামী লীগ তা করে না। দলের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাঁর নেতৃত্বের দল জনগণ থেকে দূরে নয়।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘আমলারা আমলাদের জায়গায়, রাজনীতিবিদরা রাজনীতির জায়গায়। আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আওয়ামী লীগই গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দল। এ দলই মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’

আওয়ামী বলছে, দলের সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে। পরবর্তী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের আরো শক্তিশালী করে তুলতে দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি নির্বাচনী জোট সম্প্রসারণে বিকল্পগুলো নিয়েও ভাবছে দলটি। এ পরিকল্পনা মাথায় রেখে দলটি সমমনা বামপন্থি ও কয়েকটি মধ্যপন্থি ইসলামী দলের সঙ্গেও আলোচনা করবে। ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের’ দাবি নিয়ে বিরোধীদলের যে কোনো সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। ২০২২ সাল দলের কাছে কেন্দ্রীয় ‘সম্মেলনের বছর’। সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো ও বিভিন্ন কর্মসূচির ভেতর দিয়ে নেতাকর্মীদেরকে নির্বাচনের জন্য তৈরি করছে দলটি।

শেয়ার করুন