যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে প্রাণে বাঁচতে মরিয়া চেষ্টায় সীমান্ত অঞ্চলগুলোর দিকে পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। একই পথ বেছে নিয়েছেন আটকে পড়া বহু ভারতীয় শিক্ষার্থীও। কিন্তু সীমান্ত পেরোতে এসে শত শত ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ইউক্রেনের সেনা ও নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুমুল হেনস্থা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের সীমান্তে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সীমান্ত পেরোতে বাধা দিয়ে মারধর করার একটি ভিডিও সামনে এসেছে, দেশের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী সেটি সোমবার সকালে টুইটারে শেয়ারও করেছেন।
সেখানে মেয়েদের পর্যন্ত চুলের মুঠি ধরে টানা হচ্ছে এবং রড দিয়ে পেটানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সীমান্তে কী রকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে তাদের পড়তে হচ্ছে, তা বর্ণনা করে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অজস্র ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেছেন। ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে কথাবার্তাও চালাচ্ছে।
কেরালার মেয়ে অ্যাঞ্জেল, যিনি ইউক্রেনের একটি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ভোররাতে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে জানান, পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে শেহায়নি-তে শত শত ভারতীয় ছাত্রকে সীমান্ত পেরোতে বাধা দিচ্ছে ইউক্রেনের পুলিশ ও সেনারা।
তাদের বেধড়ক পেটানো হচ্ছে, রাস্তায় ফেলে পর্যন্ত মারা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য করে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ভয় দেখাতে শূন্যে গুলি পর্যন্ত চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ জানান ওই ছাত্রী – যে বার্তা ভারতে হুলুস্থূল ফেলে দেয়।
এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয় একটি ভিডিও – যেখানে সীমান্ত পোস্টের মতো দেখতে একটি জায়গায় সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের স্যুটকেস নিয়ে আসা নিরীহ লোকজনকে লাথি মারতে দেখা যায়। পেছনে একজনকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, “আরে মেয়েদেরও কীভাবে মারছে দেখুন”।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ২৮ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) সকালে ওই ভিডিওটি পোস্ট করে লেখেন, “আমরা আমাদের নিজেদের লোকদের এই অবস্থায় ফেলে দিতে পারি না।”
পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে বাধ্য হয়ে কিয়েভে ফিরে যাওয়ার পথে মানসী চৌধুরী নামে একজন ছাত্রী ভারতের একটি নিউজ চ্যানেলকে জানান, তাদের ওপর প্রচন্ড অত্যাচার চালানো হয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা আমাদের সাহায্যের চেষ্টা করলেও ইউক্রেনের বাহিনী সীমান্তে ব্যারিকেড দিয়ে ভারতীয়দের আটকে দিচ্ছে। মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে টানা হচ্ছে, রড দিয়ে মেরে হাত-পা পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
- আরও পড়ুন >> রাশিয়ার পাঁচ হাজারের বেশি সেনা নিহত: ইউক্রেন
এই ছাত্রছাত্রীরা প্রায় সবাই কিয়েভ বা দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে বাসে বা গাড়িতে চেপে সীমান্তে এসেছিলেন। অনেককে সীমান্ত অবধি পৌঁছতে বিশ-তিরিশ মাইল হাঁটতেও হয়েছে। তাদের মধ্যে খুব কমজনই সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ড, রোমানিয়া বা হাঙ্গেরিতে ঢুকতে পেরেছেন – বেশির ভাগকেই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে আধপেটা খেয়ে খোলা আকাশের নিচে কাটাতে হচ্ছে।
কমল ভোরা নামে আর একজন ছাত্রী ফেসবুকে জানিয়েছেন, রোমানিয়া সীমান্তেও সে দেশের সেনা তার বন্ধুদের মারধর করছে, তাদের সঙ্গে অসভ্যতা করা হয়েছে – এমন ভিডিও তিনি হাতে পেয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত বিমান পাঠিয়ে বা সেনা পাঠিয়ে যে কোনওভাবে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাক, সরকারের কাছে এই আর্জিও জানান তিনি।
পাঞ্জাবের একজন ছাত্র গুরদীপ সিং জানান, নাইজেরিয়া বা আফ্রিকার অন্যান্য দেশের ছাত্রদের সীমান্ত পেরোতে দেওয়া হলেও শুধু ভারতীয়দেরই আটকানো হচ্ছে। এদিকে কিয়েভে এখনও আটকে পড়ে রয়েছেন বেশ কয়েক হাজার ভারতীয়, তাদেরও দিন কাটছে অসহায় অবস্থার মধ্যে।
আরও শ’পাঁচেক সতীর্থর সঙ্গে একটি ভবনের বেসমেন্টে আশ্রয় নেওয়া শচী জিন্দাল বলছিলেন, তিনদিন ধরে ভারতীয় দূতাবাস তাদের বের করে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও এখনও কিছুই করেনি, এখন তারা ফোন ধরাই বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে প্রতি পাঁচ মিনিটে শহরে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। আমরা একজনের খাবার দশজনে ভাগ করে খাচ্ছি, তাতে সমস্যা নেই – কিন্তু দূতাবাস আমাদের দায়িত্ব তো নিক, উদ্ধার করার জন্য কিছু তো করুক!
পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তে ভারতীয়দের যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তা স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও। মি. শ্রিংলা রোববার রাতে এক সাংবাদিক বৈঠকে জানান, তিনি নির্দিষ্ট করে এই বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, টেলিফোনে সরাসরি সীমান্তে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ইউক্রেন দূতাবাস বিষয়টির সুরাহা করবেন বলেও কথা দিয়েছেন।
তবে পরিস্থিতি যে খুবই কঠিন, সে কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব আরও একটু ধৈর্য ধরারও আবেদন জানান।
এদিকে ইউক্রেন থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনতে দিল্লি ‘অপারেশন গঙ্গা’ নামে অভিযান শুরু করেছে, তার আওতায় চারজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী আজ ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী চারটি দেশ – পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার পথে রওনা দিয়েছেন।
তারা নিজেরা সীমান্তে দাঁড়িয়ে উদ্ধার অভিযানের তদারকি করলে ভারতীয় নাগরিকদের হেনস্থা অনেক কমবে বলে সরকার আশা করছে।
সূত্র : বিবিসি