যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই মৃতু্য। আর যুদ্ধ মানেই সর্বনাশ। যে জিতুক আর যে হারুক; যুদ্ধ মানে দেশ, জাতি আর মানুষের হাহাকার। তবু মানুষ যুদ্ধ দেখে, দেখতে বাধ্য হয়। আজ দুনিয়া দেখছে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণ। অতর্কিত বা অকস্মাত্ কি না; বলেকয়ে এই আক্রমণ করেছে রাশিয়া। সেই রাশিয়া যাদের আফগানিস্তান ছাড়া আর কোথাও যুদ্ধ ছেড়ে চলে আসার ইতিহাস নেই, বরং আছে জয়ের কাহিনি। একসময়, অর্থাত্ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া না জিতলে মিত্র শক্তির জয় ছিল অসম্ভব, যার মানে, জিতত হিটলার। বদলে যেত দুনিয়ার রাজনীতি বা দুনিয়াই। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের বিরাট দেশটি ভাঙার পর টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই টুকরোর একটি ইউক্রেন। লাগোয়া প্রতিবেশী আর অতীতের যুক্ত ইতিহাস রাশিয়া আর ইউক্রেনকে যেমন একে অপরের পরিচিত করে রেখেছে, তেমনি আছে বৈরিতা। অনেকটা ভারত-পাকিস্তানের মতো। কিন্তু ইউক্রেনের সাধ্য নাই রাশিয়ার বিরোধিতা করে টিকতে পারে। হয়তো সে কারণেই পুতিনের ভয় আর রাশিয়ার বিশালতার কথা ভেবে ইউক্রেন ভরসা চেয়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে।
ইউক্রেনকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ না নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু তখন ইউক্রেনের চোখে স্বপ্ন তার পাশে বিলেত-আমেরিকা। আমেরিকার কথাই যখন উঠল, বলতে হয়, ইতিহাসে তাদের যুদ্ধজয়ের কোনো কাহিনি নেই। আছে পরাজয় বা ফেলে চলে আসার করুণ ইতিহাস। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমেরিকা নাকি যুদ্ধ জেতার চাইতে যুদ্ধের মেয়াদ দীর্ঘ করতে আগ্রহী। এতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো জমে। ইউক্রেনের নিশ্চয়ই এসব কাহিনি অজানা ছিল না। তবু তারা তাদের অস্তিত্ব বা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে গিয়েছে। এন্তার অস্ত্রশস্ত্র জমা হয়েছে তাদের ভান্ডারে। অথচ একটা সহজ সমীকরণ হলো—রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মুখে যাই বলুক, কাজে কোনো অ্যাকশনে যাবে না ইউরোপ-আমেরিকা। এমনকি দুনিয়া কাঁপানো রক্তের হোলিখেলায় বিশ্বাসী সন্ত্রাসী বা টেররিস্টরাও এটা বোঝে। তাই তারা দুনিয়ার সব দেশে ঢুকলেও ঐ সব দেশের ছায়া মাড়ায় না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এখন যখন রাস্তায় নেমে যুদ্ধ করার কথা বলছেন, তখন এই প্রশ্নগুলো মাথাচাড়া দেয় বৈকি।
যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ আর মারাত্মক হতে পারে, তা আমাদের চাইতে ভালো কে জানে? দুনিয়ার সব মিডিয়া আর সংবাদকর্মীদের কথা বাদ, এক ভুক্তভোগী বাঙালির কথা শুনুন। তিনি লিখেছেন : বুধবার রাত ৩টা। হঠাত্ প্রবল শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভূমিকম্প বোধহয়! এক বন্ধুর ফোনে ঘুমের রেশ কাটতেই সম্বিত ফিরল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আশপাশে কোথাও ক্ষেপণাস্ত্র হানা হয়েছে। সেই জায়গা আমাদের এলাকা থেকে অনেকটা দূরে, এই ভেবে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু সেই স্বস্তিটুকুও উধাও হয়ে গেল শুক্রবার সকালে। আমাদের শহর খারকিভের কেন্দ্রস্হল নকোভায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলো এবার। ধ্বংস হয়েছে অনেক কিছুই। আর না ফোটা ক্ষেপণাস্ত্র রাস্তায়ই গেঁথে রয়েছে। আমরা যে বাড়িতে থাকি, সেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কার রয়েছে। বুধবার রাতেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছি। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে। বাঙ্কারে হিটার নেই। গরম পোশাক পরেও ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। সঙ্গে সম্বল বলতে দিন ছয়েকের খাবার। এই কদিন রাত হলেই খাবার, পানীয় জল কিনতে দোকানে লম্বা লাইন পড়ছিল। শুক্রবার হামলার পরে দোকানপাটও বন্ধ। যাদের বাড়িতে বাঙ্কার নেই, তারা প্রাণ বাঁচাতে মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন।
এই অবস্হা এখন বাস্তবতা। সে দেশের নানা শহরে বসবাসরত চিকিত্সা পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশিরা আছেন ঘোর বিপাকে। তাদের বয়ানে পাচ্ছি জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে সেই দেশ ছাড়ার খবর। কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, কীভাবে থাকবেন সবটাই অনিশ্চিত। আর এটাই হলো যুদ্ধের বিভীষিকা। আমি রাশিয়া বা ইউক্রেন কারো ভূমিকা নিয়ে বলার চাইতে বলতে চাইছি জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে। এই লেখাটি লেখার সময় দেখলাম জাতিসংঘের মহাসচিব অনেকটা বালকের মতো নিজেদের ডিফেন্ড করছিলেন। আত্মসমর্থনের জন্য তাদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে সেই কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু টিকাদান মহামারি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে শান্িতবাহিনী পাঠানো এসব কি আসলেই জাতিসংঘের মুখ্য কাজ? এমন কাজ তো আগা খান ফাউন্ডেশন বা আনজুমানে মফিদুল ইসলামও করে যার যার সাধ্যমতো। কথা ছিল জাতিসংঘ হবে বিশ্বস্বস্তি আর শান্িতর নিশ্চয়তা দেওয়ার আশ্রয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ বিষয়ে সেই ভরসা আর আশাই বড় হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর মানুষের মনে। আমেরিকার রুজভেল্ট, ব্রিটেনের চার্চিল বা অন্য দেশের নেতারা সে কথা দিলেও তা রাখতে পারেনি জাতিসংঘ। বাস্তবে আমেরিকা ও ব্রিটেনের একচ্ছত্র আধিপত্য আর তাদের হাতের পুতুল হয়ে ওঠা জাতিসংঘকে এখনো ভারত, ব্রাজিল বা কোরিয়ার মতো দেশও ভয় পায় না, চীন-রাশিয়া তো দূরের কথা। যত সময় গেছে, দুনিয়া বুঝে নিয়েছে জাতিসংঘ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান, যে বিবৃতি দেবে। যে কথা বলবে। যার প্রধান বা কর্মকর্তারা ঘন ঘন টিভিতে আসবেন কিন্তু তার কথা অনেকেই মানবে না। আজ জাতিসংঘের মহাসচিবকে দেখে সেটাই সত্য মনে হলো।
আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে চীন-রাশিয়া বা বড় শক্তি হয়ে ওঠা দেশগুলোর তফাত এখন দৃশ্যমান। আমেরিকা বা ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রাখার জন্য মরিয়া, কিন্তু বাস্তবে অন্যরাই হয়ে উঠেছে শক্তিশালী। ভারসাম্যের এই খেলায় জাতিসংঘ পারেনি তার জায়গা ঠিক রাখতে। পারলে আজ এই আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত থামাতে পারত। কে শুদ্ধ আর কে ভুল সেটা বড় বিষয় না, বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যে কোনো যুদ্ধেই সাধারণ মানুষ আর তাদের ভবিষ্যত্ বিপন্ন হয়। এমনিতেই করোনার কারণে সব দেশের অর্থনীতি নাজুক। মানুষ আছে ঘোর সংকটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর লাফিয়ে বাড়ছে তেলের দাম। তেলের দাম বাড়া মানেই সব জিনিসের দাম বাড়তে থাকা। দুনিয়ার নাজুক ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর বিষফোঁড়া এই যুদ্ধ জাতিসংঘ থামাতে পারবে? মনে হয় না। কারণ পুতিনের দেশের আছে ভেটো পাওয়ার। আর সেই পাওয়ার ইতিমধ্যে ব্যবহার করেছে রাশিয়া। তাছাড়া বড়সড় কয়েকটি দেশ না ঘর না ঘাটকা হয়ে কিছুই বলছে না। সব মিলিয়ে ইউক্রেনের বিপদ শিগ্গির কাটবে বলে মনে হয় না।
সবচেয়ে যেটা বড় তা হলো জানমালের নিরাপত্তা। আর সভ্যতা বা নিরীহ মানুষকে বাঁচানো। দম্ভ বা শক্তি পরাজিত হয় বটে; কিন্তু রেখে যায় তার পদরেখা। ভয়াবহ সেই পদরেখা থামাতে না পারলে জাতিসংঘের দরকার বা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। রাশিয়া না ইউক্রেন—এই বিতর্কে বাঙালি যা-ই বলুক, আমরা বলব, শান্িত আর শান্িত।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক