কারো দুর্নীতির অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ দেয়, তা প্রায় সময় ‘উপস্থিত বুদ্ধি, সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে’ সাজানো। দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গোয়েন্দাবৃত্তির বিষয়ে আলাদা প্রশিক্ষণ নেই। অনুসন্ধান কালে তারা নিজের কাছে যা ‘মনে হয়’, তা ‘প্রতিবেদনে’ লিখে দেন। ফলে অভিযুক্তের দুর্নীতির বিষয়ে অধিকাংশ সময় প্রকৃত তথ্য বের হয় না। এমনকি সংস্থাটিতে কর্মরতদের দুর্নীতির তথ্যও তুলে আনতে পারছে না গোয়েন্দা অনুবিভাগ। দুর্নীতি রোধ, এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্বে থাকা এ সংস্থার ‘গোয়েন্দাবৃত্তির’ ধরনের নানা দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে মত ও পথের অনুসন্ধানে।
জানা যায়, ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজস্ব ‘গোয়েন্দা অনুবিভাগ’ চালু হয় দুদকে। এর আওতায় দেশের ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দায়িত্বে আছেন ২২ কর্মকর্তা। তাদের কারো এ বিষয়ে পেশাদারত্ব নেই। সংস্থাটির দায়িত্বে নেই পেশাদার কোনো গোয়েন্দা কর্মকর্তা। দায়িত্বপ্রাপ্তদের মূল দায়িত্ব গোয়েন্দাবৃত্তি নয়, এটা তারা করে থাকেন ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ হিসেবে। বাইরের কারো বদলে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলে অন্য কর্মকর্তার ‘গোয়েন্দাবৃত্তি’। সম্প্রতি সংস্থাটির চাকরি হারানো কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন এর শিকার হন বলে অভিযোগ আছে।
অনুসন্ধান বলছে, সংবাদমাধ্যমে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিষয়ে প্রকাশিত, প্রচারিত প্রতিবেদনকে দুর্নীতি জানার অন্যতম মাধ্যম বলে মনে করতে হয় দুূদককে। সংস্থাটির কাছে বিভিন্ন ব্যক্তি পর্যায় থেকে চিঠি আসে অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অনিয়ম প্রসঙ্গে। দুটিই দুর্নীতির অভিযোগ প্রাপ্তির বিশেষ মাধ্যম। অভিযোগ জানিয়ে চিঠি এলে সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ে সংস্থাটির কোনো নীতিমালা নেই। কীভাবে অভিযোগ দিলে তা তফসিলভুক্ত হবে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত মানদণ্ড না থাকায় দুদকের বাছাই কমিটি চিঠি নির্ধারণ করে ‘খেয়াল-খুশিমতো’। চিঠিতে উল্লেখ থাকা দুর্নীতির তদন্ত সম্ভব হয় না শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগ না থাকায়। ফলে দুদকের মামলার সংখ্যা, গ্রেপ্তার কমে গেছে।
‘সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তারের ঘটনা কমেছে’, এটা মানতে রাজি নন দুদক সচিব মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো ঘটনার প্রথম তথ্য পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করি, কীভাবে কাজ করতে হবে। তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন আমরা থেমে নেই। কোনো কারণে থামার কোনো আশঙ্কা নেই।’
দুদককে ঘিরে সক্রিয় প্রতারক চক্রকে সংস্থাটি শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পারছে না সবল গোয়েন্দাবৃত্তি না থাকায়। সংস্থাটির কর্মকর্তা, কর্তৃপক্ষের নাম ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে একাধিক প্রতারক চক্র সক্রিয়। কাল্পনিক অভিযোগ থেকে অব্যাহতি, কোনো বিষয়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে জানিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে অনৈতিক টাকা দাবি করে চক্র। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায়ই ধরা পড়েন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। দুদকের গোয়েন্দাবৃত্তিতে তাদের ধরা সম্ভব হয় না।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সচিব বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘দুদকের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণায় নেমেছে এক বা একাধিক চক্র। বিভিন্ন পেশা, শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে অর্থ দাবি বা আদায়ের বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে কমিশন। কোনো কোনো প্রতারক নিজেকে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তা, কর্তৃপক্ষের আত্মীয় কিংবা পরিচিত অথবা বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।’
স্বপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতির খোঁজ করা, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে দুদকের গোয়েন্দা বিভাগের যাত্রা। এর কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ২০২০ সালের ৮ মার্চে দেশের ২২টি জেলায় বিস্তৃত করা হয়। তবে যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া বিভাগটির কার্যক্রম শুরু হয়। চালুর পর জনবল বাড়ানো হয়নি।
দুদক বলছে, দুর্নীতিবাজদেরকে কঠোর নজরদারিতে আনতে, তাদের গোপন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়টি আরো গতিশীল করতে বিদ্যমান গোয়েন্দা অনুবিভাগকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিভাগ সাজানো হবে উন্নত দেশের দুর্নীতিবিরোধি প্রতিষ্ঠানগুলোর আদলে।
সংস্থাটির মহাপরিচালকের অধীনে পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা অনুবিভাগে দুই পরিচালক, পাঁচ উপপরিচালকসহ শতাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। দুদকের আটটি বিভাগীয়, ৩৬টি জেলা কার্যালয়ে থাকবে গোয়েন্দা বিভাগের কার্যক্রম। সঙ্গে থাকবে উন্নতর প্রশিক্ষণ, অত্যাধুনিক গোয়েন্দা যন্ত্রপাতির সুবিধা। গত ১৮ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে কমিশনের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।
দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘বর্তমান কমিশন আগের চেয়ে শক্তিশালী। আরো ভালো কিছু করার চেষ্টা চলছে। দুর্নীতিবিরোধি কার্যক্রমে গোয়েন্দা বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিভাগকে সম্প্রসারণের, এর সক্ষমতা বাড়ানোর চিন্তা করছি আমরা।’