কিয়েভসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো অবরোধের পথে রুশ বাহিনী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাশিয়ার ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সামরিক বহর
রাশিয়ার ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সামরিক বহর। সংগৃহীত ছবি

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো অবরোধের পথে এগোচ্ছে রুশ বাহিনী। হামলার সপ্তম দিনেও বড় কোনও শহর দখল করতে পারেনি তারা। খেরসন শহরে দখলের দাবি করলেও স্থানীয় মেয়র এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, বুধবার বিকালের দিকে খেরসন শহর অবরোধ করেছে রুশ সেনারা। দক্ষিণাঞ্চলীয় মারিউপোলও ঘিরে রেখেছে তারা।

বুধবার (২ মার্চ) সকালে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসন দখলের নেওয়ার দাবি করেছে। রাশিয়ার দাবি সত্য হলে চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে এটিই হবে রুশ বাহিনীর দখল করা বৃহত্তম শহর।

প্রায় তিন লাখ মানুষের শহর খেরসন। এটি মিকোলাইভ এবং নিউ কাখোবকা শহরের মধ্যে অবস্থিত। তবে শহরটির মেয়র দাবি করেছেন, এটির নিয়ন্ত্রণ এখনও ইউক্রেনের হাতে।

খেরসনের আঞ্চলিক মেয়র জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতেও শহর ঘেরাও ছিল। রুশ সেনারা দোকান ও ফার্মেসিতে লুটতরাজ চালিয়েছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা ওলেকসি আরেস্টোভিখ জানান, বন্দরে লড়াই চলছে। শহরের পতন হয়নি। আমাদের বাহিনী প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

মেয়র ইগোর কোলিখায়েভ বলেন, আমরা এখনও ইউক্রেন, এখনও শক্ত আছি। নিহতদের মরদেহ সংগ্রহ এবং যেসব স্থানে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও হিটিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো মেরামত করা দরকার।

দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর মারিউপোলের মেয়র জানিয়েছেন, তাকে আত্মসমর্পণের আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আত্মসমর্পণ না করলে গোলার আঘাতে শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হবে।

সামি অঞ্চলের কোনোটপ শহরের মেয়র আর্টেম সেমেনিখিন স্থানীয় বাসিন্দাদের বলেছেন, তারা আমাদের আলটিমেটাম দিয়েছে। আমরা যদি প্রতিরোধ করি তাহলে কামান দিয়ে আমাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে। আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে আমরা লড়বো।

ভারী গোলাবর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের মেয়র বলেছেন, আত্মসমর্পণের কোনও ইচ্ছা তাদের নেই।

এরইমধ্যে অনেক জায়গায় খাদ্য স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। অবরোধকৃত এলাকাগুলোতে হাসপাতাল পরিচালনার সামর্থ্য নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কয়েকজন পশ্চিমা কর্মকর্তা আশঙ্কা করতে শুরু করেছেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনী চেচনিয়া ও সিরিয়ার যুদ্ধে বেসামরিকদের বিরুদ্ধে যে কৌশল অবলম্বন করেছিল, এখানেও সেটি করতে পারে। এই কৌশলের মধ্যে রয়েছে ‘স্কর্চড-আর্থ’।

মারিউপোলের কর্মকর্তা ও রক্ষীরা বুধবার ঘেরাওয়ের শিকার হয়েছেন। রুশ সেনারা বেসামরিক স্থাপনায় শেল নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুতেদের জন্য নির্মিত ডরমেটরিও বাদ যায়নি রুশ গোলার আঘাত থেকে।

একজন সেনা সদস্য গার্ডিয়ানকে জানান, এটি স্পষ্ট রুশ সেনারা আমাদের ঘিরে ফেলতে ও অবরোধ করতে চাইছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে শহর রক্ষার জন্য লড়াই চলছে। শহরে মাত্র একদিক থেকে প্রবেশ করা যাচ্ছে। কিয়েভ ও খারকিভে তারা যা করেছে সেটি মারিউপোলেও করতে চাইছে। আমাদের ঘিরে ফেলে কামান দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চায় তারা।

মারিউপোলের মেয়র ভাদিম বইচেঙ্কো বলেন, তারা চায় বেসামরিকদের হত্যা ও স্থাপনা ধ্বংস করতে। তাই আমাদের অবশ্যই রুশদের ঠেকাতে হবে। ১২ ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ চলছে। এমনকি রাস্তা, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আহতদের সরিয়ে আনতে পারছি না। কারণ, গোলাবর্ষণ থামছেই না।

রাজধানী কিয়েভের চারপাশেও রুশ সেনারা অবস্থান করছে। শহরের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো বুধবার অনলাইনে এক পোস্টে লিখেছেন, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং কিয়েভকে রক্ষা করবো। কিয়েভ রুখে দাঁড়াবে এবং টিকে থাকবে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের পর্যালোচনায় ইউক্রেনে রাশিয়ার কৌশল বদলের ইঙ্গিত দেওয়ার পর রুশ সেনারা অবরোধ জোরদারের পদক্ষেপ নেওয়ার খবর পাওয়া গেলো। পেন্টাগন আশঙ্কা করেছিল, রুশ সেনারা বিভিন্ন শহর অবরোধ করে বেসামরিকদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। একই সময়ে শহরগুলোতে বোমা বর্ষণ অব্যাহত রাখবে। যুদ্ধে অবরোধের ক্ষেত্রে এসব কৌশল সাধারণত ব্যবহার করা হয়।

এমন আতঙ্কের সঙ্গে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও যোগ করেছে, তারা দেখেছে রুশ বিমান বাহিনী শহুরে জনবহুল এলাকাগুলোতে গত দুই দিন ধরে বোমাবর্ষণ বাড়িয়েছে।

ইউক্রেনীয় শহরগুলো অবরোধের পথে রুশ কৌশলের বিষয়ে রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের ম্যালকম চালমার জানান, এই অভিযান রাশিয়ার গোয়েন্দা তথ্য ও কৌশলে ব্যর্থতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে পুতিনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, দখল আরও সহজ হবে এবং শুরুর দিকে রুশ সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি ভুল করেছে। সামরিক সরঞ্জাম ও বিমান সহায়তা নিয়ে সমস্যা ছিল। কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে রুশ সশস্ত্র বাহিনী বেশ দক্ষ। তাই এখন তারা অবরোধের কৌশল নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দুটি বিকল্পেই জটিলতা রয়েছে। এলাকা ধরে ধরে যদি রুশদের লড়াই করতে হয় তা হবে কঠিন এবং ব্যাপক হতাহত হবে। এমনকি ইরাকে খুব ভালো সমন্বিত ইরাকি সেনাবাহিনী মসুলে আইএসের বিরুদ্ধে হামলায় ন্যাটোর বিমান হামলার সহযোগিতা নিয়েছে। তবু তা ছিল খুব ধীর গতির। আর যত দিন যাবে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধকারীরা নিজেদের সংহত করার সুযোগ পাবে।

তার মতে, যদি তারা শহরের বাইরে থেকে গোলা বর্ষণ করে ইউক্রেনীয়দের আত্মসমর্পণ করানোর আশা করে তাহলে শহুরে বাসিন্দাদের ব্যাপক হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তারাও ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর কৌশলে কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত করছেন। তারা বলছেন, রুশ সেনারা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং মাল্টিপল রকেট লঞ্চ ব্যবস্থা বেশি ব্যবহার করছে।

রুশ কৌশল বদলের বিষয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, জনবহুল এলাকায় হামলা বাড়ানো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। তিনি বলেন, কেউ ক্ষমা করবে না, কেউ ভুলবে না।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

শেয়ার করুন