বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কিংবদন্তি গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। গেল বছরের ২৩ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার গান ও কর্ম রয়ে গেছে এদেশের মানুষের অন্তরে অন্তরে। দেশের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি চর্চায় ফকির আলমগীরের অবদানের জন্য ফকির আলমগীর চিরদিন স্মরণীয় এবং বরণীয়। দীর্ঘ জীবনে তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
এবার মৃত্যুর পর ফকির আলমগীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার নামে রাজধানী ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া ৬ নম্বর সড়কের সামনে ফকির আলমগীর সড়কের ফলকটি বসানো হয়েছে। এখন থেকে এই সড়কটি কিংবদন্তি এ শিল্পীর নামেই পরিচিত হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে ফকির আলমগীরের পুত্র মাশুক আলমগীর রাজীব বলেন, ‘এটা সত্যি দারুণ উদ্যোগ আমার বাবাকে সম্মান জানানোর। আমি, আমার পরিবার ও পরিজন এই সম্মানে আপ্লুত। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয় আতিকুল ইসলাম সাহেবের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এই এলাকায় অনেক স্মৃতি আছে। তিনি এখানে জীবনের অনেক সময় কাটিয়েছেন৷ এই এলাকার মানুষ তাকে সম্মান করতেন৷ সেখানে বাবার নামে সড়ক, ভাবতেই ভালো লাগছে।’
প্রসঙ্গত, ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিনটিতে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেসা। শিল্পী কালামৃধা গোবিন্দ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ফকির আলমগীর ষাটের দশক থেকে সংগীতচর্চা করেছেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি বংশীবাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গণ–অভ্যুথান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন তাঁর গান দিয়ে।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করার জন্যই দেশজ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ও তাঁর সময়ের কয়েকজন শিল্পী শুরু করেছিলেন প্রথম বাংলা পপ ধারার গান। বাংলা পপগানের বিকাশেও তাঁর রয়েছে বিশেষ অবদান।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ফকির আলমগীরের গাওয়া ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’ ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’সহ বেশ কিছু গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে ‘ও সখিনা’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৮২ সালের বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পর দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে। কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি গানটির সুরও করেছেন ফকির আলমগীর।
তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি, জনসংযোগ সমিতির সদস্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন।