বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিকতা

হাসান শান্তনু

ফাইল ছবি

গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময়টা সৃষ্টি, ধ্বংস ও অস্থিরতার। বাঙালি জাতীয়তার জোয়ার তখনো প্রখর হয়ে ওঠেনি। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার অঙ্গনকেও সেভাবে প্লাবিত করতে পারেনি। গণমানুষের মুক্তির জন্য তখন উপমহাদেশের প্রখ্যাত অনেক রাজনীতিবিদ বিভিন্ন সময় খবরের কাগজ প্রকাশ করেছেন। এ তালিকায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও আছে।

তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর জীবনের এ অধ্যায় এখনো বেশ অনালোচিত। অথচ তাঁর বর্ণময় জীবনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক সাংবাদিকতা, বাঙালির ইতিহাসেরও বিশেষ অধ্যায়। গণমাধ্যমের ইতিহাসের জন্যও যা ভীষণ গৌরবদীপ্ত বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর মতো রাষ্ট্রনায়কদের জীবনে বৈচিত্র্যময় নানা অধ্যায় থাকে। সে সব অধ্যায় জাতির সামনে তুলে ধরতে হয় গবেষণার মধ্য দিয়ে। স্বীকার করা জরুরি, তাঁর রাজনৈতিক সাংবাদিক জীবন নিয়ে গবেষণা তেমন হয়নি। ইতিহাসের অজানা এ উপত্যকায় জোছনার আলো এখনো যেন পড়েনি। বঙ্গবন্ধু কখনো ছিলেন পত্রিকার মালিক, কখনো সাংবাদিক, কখনো পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি, কখনো পরিবেশক, কখনো উৎসাহদাতা, সাহসের বাতিঘর, উদ্যোক্তা, প্রেরণা, আদর্শ ও অভিভাবক। আবার বিজ্ঞাপন জোগাড়, পত্রিকা বিক্রির কাজ- এ রকম দায়িত্বও পালন করেন বাংলাদেশের এই স্থপতি। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এসবের টুকরো টুকরো উল্লেখ আছে।

সাত চল্লিশে দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানি শাসনামলের ২৩ বছরের বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ কিংবা সহায়তায় নানা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পাকিস্তান আমলের একপর্যায়ে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের নতুন দিনের জন্য তার আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে মিল রেখে করা হয় পত্রিকার নামকরণ। ওই পত্রিকা একটা পর্যায়ে হয়ে ওঠে গণমানুষের মুখপত্র। পত্রিকাটিতে তিনি নিজেও সাংবাদিকতা করেন। পরে পাকিস্তানি শাসকরা পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু আরো কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

পত্রিকা প্রকাশ করে জনগণকে দীক্ষিত করেন মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রামে। একজন রাজনীতিবিদ, ভৌগোলিক সীমারেখার স্রষ্টা তো বটেই, তিনি নিপীড়িত-শোষিতদের অধিকার আদায়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন বা সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানাভাবে পত্রিকা প্রকাশ এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, জনগণের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেই বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকতা করেন, পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ব্রিটিশ আমলেও তিনি একটি পত্রিকার ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি’ ছিলেন।

তাঁর শতাব্দীতে কয়েকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদও ছিলেন কোনো না কোনো পত্রিকা বা ‘রাজনৈতিক সাংবাদিকতার’ সঙ্গে যুক্ত। মহাত্মা গান্ধী ‘নিউ ইন্ডিয়া’, মতিলাল নেহরু ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’, মাওলানা মুহম্মদ আলী ‘কমরেড’, সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি ‘বেঙ্গলি’, অরবিন্দ ঘোষ ‘বন্দেমাতরম’, সুভাষ চন্দ্র-‘ফরওয়ার্ড’, বিপিন চন্দ্র পাল- ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘নারায়ণ’, ফজলুল হক ‘কৃষক’ ও ‘নবশক্তি’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘হক কথা’র নামটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘নতুন দিন’, ‘ইত্তেহাদ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘মিল্লাত’সহ কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে। এসব পত্রিকার জন্য তিনি বিজ্ঞাপন জোগাড় করেন তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধুর গণমাধ্যমপ্রেম বা উজ্জ্বল সাংবাদিক জীবনের ঘটনার সাক্ষী।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সংবাদপত্রের গুরুত্বের কথা অনুভব করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই সংবাদপত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এতো ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনী পড়লে জানা যায়, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করতেন তারা। সংবাদিকদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতেন। কেননা প্রতিটি দেশেরই জনগণ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সংবাদপত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেতু বন্ধন রচনা করে।

যোগযোগের কল্যাণে একজন রাজনৈতিক নেতা তার দেশ, মাটি, মাতৃভূমিকে নিয়ে কী ভাবছেন, তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে ১৪ বার গ্রেফতার হন, প্রায় ১৪ বছর কারাগারে থাকেন। দুইবার ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়! পাকিস্তানি আমলে কারাগারের বাইরে থাকা রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবের সাংবাদিকতার সময় কতোটুকু ছিল?

কেমন ছিল তাঁর সাংবাদিক জীবন? কী ছিল তার সাংবাদিকতার দর্শন? পাকিস্তানিরা প্রকাশনা বন্ধ করে দিলেও তিনি কেন একটার পর একটা পত্রিকা প্রকাশ করিয়ে ছিলেন ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে? এসব পত্রিকার নীতিমালা, আদর্শ কেমন ছিল? যিনি একটা পর্যায়ে হবেন রাষ্ট্রপিতা, তিনি একদিন পত্রিকা বিক্রির কাজও করেন! মুজিব ছাড়া আর কোনো দেশের স্থপতির জীবনে এ দিকটার খোঁজ মেলে? তাঁর শান্তিপূর্ণ, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র চেতনার সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতা দর্শনের মিল পাচ্ছেন গণমাধ্যম গবেষকেরা।

বঙ্গবন্ধু কেবল একজন রাজনীতিক ছিলেন তা নয়, একজন প্রকৃত সাংবাদিকবান্ধব রাজনীতিক ছিলেন। ওই সময় বাঙালি চেতনাকে ধারণ করে প্রগতিশীল গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল সেই সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিল হরিহর আত্মা। বাঘা বাঘা সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। পঞ্চাশের শেষ থেকে রাজনৈতিক উথাল-পাথালে সোহরাওয়ার্দী-বঙ্গবন্ধু দর্শনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো এগিয়ে চলছিল। চল্লিশের দশকেই কলকাতায় থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আড্ডার মূল জায়গা হয়ে ওঠে দৈনিক আজাদের অফিস। পরে দৈনিক ইত্তেহাদ।

ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধুর পোশাকও ছিল অনেকটা তখনকার কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের মতো! চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা, মুজিব কোটের ওপর কাঁঠালচাপা রঙের চাদর জড়ানো, মুখে পুরনো পাইপ। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হয়েও ব্যক্তিজীবনের পোশাক-আশাকের সাধারণ সাজে কোনো পরিবর্তন হয়নি সাংবাদিকতা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবের।

শুধু মুখের ভাষা প্রকাশের অধিকারই নয়- একটা গোটা জাতিকে তিনি মুক্ত করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কবল থেকে। তাঁর প্রিয় বই ছিল নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বানার্ড শ, কেনেডি ও মাও সেতুংয়ের গ্রন্থাবলি। প্রতিবারই জেলে যাওয়ার সময় তিনি ‘সঞ্চয়িতা’টা হাতে তুলে নিতেন। বইটার গায়ে পড়েছিল জেল সেন্সরের অনেক সিল। কারাগারের মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু পড়াশোনা করতেন একাগ্র চিত্তে। তিনি আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন। প্রায়ই শোনাতেন পরিবারের সবাইকে। ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেছে, ‘মুজিব মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলে ভান করেন না।’

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার ২৩ বছরে মুজিবের পত্রিকা প্রকাশ, পরিচালনা, বিক্রির ব্যবস্থা করা, তাঁর সাংবাদিক জীবন, পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমগুলোর পক্ষে তাঁর দৃঢ়তম অবস্থান, সংগ্রাম করে পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা ফিরিয়ে আনার ইতিহাসগুলো মুক্তিযুদ্ধের এত বছর বছর পরও বেশ অনালোচিত!’ অনেক দেশেই রাজনৈতিকভাবে বরণীয়দের চর্চার জন্য গবেষণাকেন্দ্র থাকলেও বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতাকে চর্চার কোনো সংস্থা তৈরি হয়নি। এমন একটি সংস্থা থাকলে এ প্রজন্মের পাঠকদের জানতে অসুবিধা হতো না যে, বঙ্গবন্ধু কোনো এককালে সাংবাদিক ছিলেন, পত্রিকাও বিক্রি করেছেন, বাদ দেননি বিজ্ঞাপনের কাজটিও। যারা এগুলো উদ্ঘাটিত করার কথা ছিল, তারা তোষামোদে ব্যস্ত হয়ে ইতিহাসের মূলকে অস্বীকার করেছেন।

আগামীকাল পড়ুন- ভারতীয় লেখকদের বয়ানে বঙ্গবন্ধু।

universel cardiac hospital

শেয়ার করুন