আফগানিস্তানের বিপক্ষে হতাশ করেছিলেন ব্যাটাররা। এনে দিতে পারেননি লড়াই করার মতো সংগ্রহ। তবু ম্যাচ জেতার জন্য প্রয়োজন ছিল সাঁড়াশি বোলিং-ফিল্ডিং। কিন্তু হলো না সেটিও। বোলাররা তাও খানিক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হতশ্রী ফিল্ডিংয়ে বৃথা গেছে সব।
মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচে ছন্নছাড়া ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের করা ১১৫ রানের সংগ্রহ মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে ১৪ বল আগেই টপকে গেছে আফগানিস্তান।
উইকেটের হিসেবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এর চেয়ে বড় ব্যবধানে আফগানদের জয় আছে আর মাত্র একটি। সফরকারীদের এ বিশাল জয়ের পেছনে বড় অবদান ছিল বাংলাদেশের ফিল্ডারদেরও। হযরতউল্লাহ জাজাই ও উসমান গনির তিনটি ক্যাচ ছেড়েছেন তারা।
শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৫ ছয়ের মারে ৪৫ বলে ৫৯ রানের ইনিংস খেলেছেন শূন্য রানে জীবন পাওয়া জাজাই। দলের জয় প্রায় নিশ্চিত করে দিয়ে ৪৮ বলে ৪৭ রানে থেমেছেন গনি। এর আগে তিনটি করে উইকেট নেন দুই তরুণ পেসার ফজল হক ফারুকি ও আজমতউল্লাহ ওমরজাই।
এই জয়ের সুবাদে টি-টোয়েন্টি সিরিজের ট্রফি ভাগাভাগি করলো আফগানিস্তান। এছাড়া মুখোমুখি দ্বৈরথে আট ম্যাচের মধ্যে পাঁচটি জিতে এগিয়েই রইলো মোহাম্মদ নবির দল। আর সুযোগ পেয়েও আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো সিরিজ জেতা হলো না বাংলাদেশের।
১১৬ রানের ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফিরতে পারতেন জাজাই। আগের ম্যাচের নায়ক নাসুম আহমেদের করা ইনিংসের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এ বাঁহাতি ওপেনার।
কিন্তু নন স্ট্রাইক প্রান্তের উইকেটের সামনে থেকে নিজের বোলিংয়ে আসা ক্যাচটি হাতের তালুতে রাখতে পারেননি নাসুম। ফলে শূন্য রানেই জীবন পেয়ে যান জাজাই। তবে জাজাইয়ের মতো ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না গুরবাজের।
শেখ মেহেদি হাসানের করা দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই লেগ বিফোরের আবেদন হয়েছিল গুরবাজের বিপক্ষে। আম্পায়ারও আউট দেন। তবে রিভিউ নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচান এ তরুণ। তাতে অবশ্য তেমন ফায়দা হয়নি তার।
কেননা এক বল পরই টপ এজ হয়ে এক্সট্রা কভারে মাহমুদউল্লাহর হাতে ধরা পড়েন ৩ রান করা গুরবাজ। সেই ওভারেই জাজাইয়ের ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে স্ট্যাম্প ঘেঁষে বল চলে যায় বাউন্ডারিতে। ফলে অল্পের জন্য বেঁচে যান জাজাই।
এরপর আর সুযোগ দেননি তিনি। দেখেশুনে খেলে এগিয়ে নিতে থাকেন দলকে। অন্যদিকে নাসুমের করা পঞ্চম ওভারের প্রথম দুই বলে ছয় ও চার হাঁকিয়ে রান রেট ঠিক রাখেন গনি। তবু পাওয়ার প্লের ছয় ওভারে ৩৪ রানের বেশি করতে পারেনি আফগানিস্তান।
পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পর ফিল্ড ছড়িয়ে গেলেও রান তুলতে খাবি খাচ্ছিলেন জাজাই ও গনি। ফলে ৮ ওভারে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় মাত্র ৪০ রান। কিন্তু সাকিব আল হাসানের করা নবম ওভারে দুই ছয়ের মারে ১৭ রান তুলে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেন জাজাই।
পরে শরিফুল ইসলামের করা দশম ওভারে বাউন্ডারি হাঁকান উসমান গনিও। এ জুটিতে সহজেই জয়ের পথে হাঁটতে থাকে আফগানিস্তান। এরই মাঝে শেখ মেহেদির করা ১২তম ওভারে আফিফ হোসেন ও ১৪তম ওভারে নাইম শেখ ছেড়ে দেন উসমান গনির ক্যাচ।
ইনিংসের ১৫তম ওভারে ফের আক্রমণে এলে আবার সাকিবকে জোড়া ছক্কা হাঁকান জাজাই। সেই ওভারের দ্বিতীয় ছক্কার সুবাদে পূরণ হয় জাজাইয়ের ফিফটি ও আফগানিস্তানের দলীয় শত রান। পরের ওভারে বল হাতে নিয়েই ৪৭ রান করা গনিকে ফেরান মাহমুদউল্লাহ।
এতে অবশ্য লাভ হয়নি তেমন। শরিফুলের করা ১৭তম ওভারের শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে স্কোর সমান করেন জাজাই। পরে নাসুমকে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করেন দারউইশ রাসুলি।
এর আগে আজকের ম্যাচেও টস জিতে ব্যাট করতে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। প্রথম ম্যাচের মতো আজও প্রথম রানটি ওয়াইড থেকে পায় বাংলাদেশ। পরপর দুইটি ডেলিভারি লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে ওয়াইড করেন ফজল হক ফারুকি।
তবে এরপরই দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। পুরো ওভারে কখনও বাইরে বের করা, কখনও ভেতরে ঢোকানো ডেলিভারিতে পরাস্ত করেন মুনিমকে। শেষ বলে লেগবাই থেকে ১ রান নিয়ে স্ট্রাইক নিজের কাছেই রাখেন মুনিম।
পরের ওভার বোলিংয়ে আসেন আফগান অধিনায়ক মোহাম্মদ নবি। দ্বিতীয় বলেই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে লং অফ দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজের লক্ষ্য পরিকল্পনা পরিষ্কার করে দেন মুনিম। কিন্তু প্রতি বলেই মারার চেষ্টা কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।
সেই ওভারের চতুর্থ বলে আগেই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেন মুনিম। যা দেখে গতি খানিকটা কমিয়ে শর্ট লেন্থে করেন নবি। যে কারণে বলের পিচ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি মুনিম। ফলে যা হওয়ার হয়েছে তাই।
বল তার ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে উঠে যায় আকাশে। মিড অফে সহজ ক্যাচ নিয়ে ১০ বলে ৪ রান করা মুনিমের বিদায় নিশ্চিত করেন শরাফউদ্দিন আশরাফ। মুনিমের বিদায়ে দ্বিতীয় ওভারেই উইকেটে আসতে হয় আগের ম্যাচের হাফসেঞ্চুরিয়ান লিটনকে।
বাঁহাতি ফারুকির করা তৃতীয় ওভারের চতুর্থ বলটি ছিল লেগ স্ট্যাম্পের ওপর বাউন্সার। জায়গায় দাঁড়িয়ে পুল করে ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা মেরে দেন লিটন। কিন্তু বেশিক্ষণ উইকেটে থাকা হয়নি তার। আক্রমণে এসেই লিটনকে ফেরান আজমতউল্লাহ ওমরজাই।
ইনিংসের পঞ্চম ওভারের প্রথম বলেই আজমতের করা সাদামাটা এক ডেলিভারিতেই মূলত আউট হন লিটন। মুনিমের মতো তার ক্যাচটিও তালুবন্দী করেন শরাফউদ্দিন আশরাফ।
লিটন ফিরে যাওয়ার পরের বলেই নিজের প্রথম বাউন্ডারি হাঁকান নাইম শেখ। একই ওভারের শেষ বলে চার মারেন আরও একটি। মনে হচ্ছিল, শুরুর ধাক্কা আজ হয়তো নাইমই সামলে নেবেন।
কিন্তু এরপর খোলসে ঢুকে যান এ বাঁহাতি ওপেনার। চার নম্বরে নামা সাকিব আল হাসানও পারেননি হাত খুলে খেলতে। ফলে পাওয়ার প্লের ছয় ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৩৩ রান করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
পরের দুই ওভারে মাত্র ৫ রান খরচ করে চাপ আরও বাড়ান মোহাম্মদ নবি ও রশিদ খান। এর মধ্যে রশিদের করা সপ্তম ওভারে নাইমকে লেগ বিফোর আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার। কিন্তু রিভিউ নিলে দেখা যায় বল পড়েছিল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে। ফলে বেঁচে যান নাইম।
এক ওভার পরই ফিরতে হয় নাইমকে। রশিদের বল সুইপ করতে গিয়ে মিস করেন তিনি। বল আঘাত হানে প্যাডে। এবার লেগ বিফোর দেননি আম্পায়ার। দ্রুত রান নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে করিম জানাতে সরাসরি থ্রোয়ে রানআউট হন নাইম। এ বাঁহাতি ওপেনার ১৯ বলে করেন ১৩ রান।
পরের ওভারে একই পথ ধরেন সাকিব আল হাসান। আজমতের খানিক খাটো লেন্থের ডেলিভারিতে পুল করতে গিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন সাকিব। উইকেটের পেছনে গ্লাভসবন্দী করে ১৫ বলে ৯ রান করা সাকিবের বিদায়ঘণ্টা বাজান রহমানউল্লাহ গুরবাজ।
প্রথম চার ব্যাটারের এমন হতাশাজনক ব্যাটিংয়ের পর ১০ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪ উইকেটে মাত্র ৪৭ রান। সেখান থেকে পাল্টা আক্রমণ করেন নিজের শততম টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা মুশফিকুর রহিম ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
বাংলাদেশের দলীয় পঞ্চাশ পূরণ হতে লাগে ১০.২ ওভার। সেখান থেকেই মূলত শুরু পাল্টা জবাবে। রশিদ খানের করা ১২তম ওভারে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকান মাহমুদউল্লাহ। সেই ওভারের শেষ চার বল থেকে ১২ রান নিয়ে নেন তিনি।
অধিনায়কের দেখাদেখি পরের ওভারের প্রথম বলেই বাউন্ডারি খুঁজে নেন মুশফিক। পরে করিম জানাতের করা ১৩তম ওভারে হাঁকান জোড়া চার। সেই ওভার থেকে আসে ১২ রান। রশিদের করা ১৫তম ওভারের প্রথম বলে চার মেরে নিজের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ২ হাজার রান পূরণ করেন মাহমুদউল্লাহ।
সেই ওভারেই তাকে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন রশিদ। উইকেটে পড়ে সোজা যাওয়া ডেলিভারি সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে লাগাতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। বল প্যাডে লাগার সঙ্গে সঙ্গে আবেদন না করে উদযাপন শুরু করেন রশিদ। আম্পায়ারও নিশ্চিত করেন ১৪ বলে ২১ রানেই থামছে মাহমুদউল্লাহর ইনিংস।
অধিনায়ক ফিরে যাওয়ার পর উইকেটে এসে দ্বিতীয় বলেই চার মারেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। পরের ওভারে আজমতের বলে দৃষ্টিনন্দন শটে বাউন্ডারির দেখা পান মুশফিকও। কিন্তু ফারুকির করা ১৭তম ওভারেই ঘটে বিপদ।
প্রথম বলে মুশফিককে আউট করার পর তৃতীয় বলে ১৪০ কিমি গতির ডেলিভারিতে শেখ মেহেদি হাসানকে বোল্ড করে দেন ফারুকি। মুশফিক খেলেন ২৫ বলে ৩০ রানের ইনিংস। রানের খাতাই খুলতে পারেননি মেহেদি। আজমতের পরের ওভারে আউট হন ৯ বলে ৭ রান করা আফিফ।
এরপর নাসুম আহমেদের ৫ ও মোস্তাফিজুর রহমানের ৬ রানের সুবাদে ১১৫ পর্যন্ত যায় দলীয় সংগ্রহ। শেষের ২৬ বলে কোনো বাউন্ডারিই হাঁকাতে পারেনি বাংলাদেশ। পুরো ইনিংসে বাউন্ডারি হয়েছে মাত্র ১২টি আর ডট বল ছিল ৫৮টি।