বিশ্বব্যবস্থার নতুন মোড় ও আমাদের করণীয়

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

আইন-কানুন, চুক্তি, রীতি, প্রথা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রগুলোর গড়ে ওঠা আন্তঃসম্পর্ককে বোঝাতেই ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা বিশ্বব্যবস্থা পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বিশ্বব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর তাই বিশ্বব্যবস্থা এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।

এর পর থেকে পশ্চিমা প্রাধান্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করে আসছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন দশকের এই এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে আসল বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটা এ সময়েই বেশি ঘটেছে। ফলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক অর্ডার বা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও আগের চেয়ে অনেক বেশি নিবিড় ও আন্তঃসম্পর্কযুক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আবার স্নায়ুযুদ্ধে প্রবেশ করেছে, যার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।

গত দুই দশকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত এগিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাট একটা পরিবর্তন এনেছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি অন্য অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের ফলে দেশগুলো বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এখন। এ সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেশ পাল্টে গেছে। আধুনিকায়ন হয়েছে, বিশ্বায়ন হয়েছে। সর্বোপরি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বণ্টন ও বাজার ব্যবস্থা পর্যন্ত সব কিছু একেবারে বদলে গেছে।

এই সুবাদে সার্বিকভাবে বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। কিন্তু সব দেশ সমানভাবে উপকারী হয়েছে এটা বলা যাবে না। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজন যে সুবিধা পেয়েছে বা অথনৈতিক উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে সার্বিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে, ধনসম্পদ বেড়েছে। এর পাশাপাশি বৈষম্য অনেক বেশি বেড়েছে। দেশে দেশে বৈষম্য যেমন বেড়েছে, তেমনি একেকটি দেশের ভেতরেও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। এটা আমরা বাংলাদেশেও দেখতে পাই। আমাদের অনেক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আবার আয় ও সম্পদের বৈষম্য অনেক বেড়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও একই অবস্থা। সার্বিকভাবে বলা হয়, পৃথিবীতে আয় ও অর্থনৈতিক সম্পদ খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। বৈষম্য চরম একটা পর্যায়ে এসেছে। এভাবেই চলে আসছে আড়াই যুগ। এর মধ্যে হয়তো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি আরো উন্নত হবে, উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু বণ্টন ও বাজার ব্যবস্থায় উন্নতি আসবে তা বলা যায় না।

এ রকম একটা পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। মহামারি আগেও হয়েছে; কিন্তু আধুনিক যুগে এত সর্বগ্রাসী মহামারি দেখা যায়নি। কভিড মোকাবেলার মহাযজ্ঞের কারণে শাসনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা উন্নতির প্রয়োজনটি আড়ালে পড়ে গেছে। এই সময়ে বিশ্বের কোথাও গণতন্ত্র ও সুশাসনের উন্নতি দেখা যায়নি। সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়েছে অর্থনীতিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে। বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে অনেকাংশে। অনেকে এটাকে অর্থনীতির নতুন স্বাভাবিকতা বলছেন।

এই অবস্থায় অর্থনীতি কভিড-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এর কাঠামো আগের অবস্থায়ই ফিরে যাবে, যেখানে উৎপাদনেই জোর দেওয়া হবে, বণ্টনে নয়। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি গুরুত্ব পাবে; কিন্তু মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়া হবে না।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব গণতন্ত্রের তুলনায় কর্তৃত্ববাদীয় শাসনব্যবস্থার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাতে পরিবর্তন আনার কোনো প্রয়াস নেই। এর পেছনে কাজ করছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও গোষ্ঠী, ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক চরম মনোভাব। বিশ্বের শাসনব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও এই পথেই চলা শুরু করেছে। এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বা অন্য যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা চেষ্টা করলেও তাদের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে কিছু করতে পারছে না। তারা মানবতার কথা বলে বটে; কিন্তু তাদের হাত-পা বাঁধা।

কর্তৃত্ববাদীরা সাধারণত নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে যেকোনো মূল্যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। ফলে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী, নেতৃস্থানীয় ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী ও আমলারা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। রাজনীতিকরা দলীয় আদর্শ তুলে না ধরে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করেন। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ওপর আঘাত না আসা পর্যন্ত বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কোনো পদ্ধতিগত পরিবর্তন চান না। আমলারা নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত থাকেন। এটা কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটা বৈশিষ্ট্য। এর ফলে রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামো, সর্বজনীন ব্যবস্থা ও মূল্যবোধগুলো থেকে বিচ্যুত হয়। এর ফলে মূল সমস্যাটা হয় যে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। যেমন—বিশ্বে এই মুহূর্তে আমরা যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দেখছি, তা মানুষের জন্য কল্যাণমুখী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে মানুষের সার্বিক মানবতা, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তার সুযোগ নিশ্চিত হচ্ছে না।

এই পটভূমিতে হাজির হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ। এটা অনেকটা চলে গিয়েছিল। কে কোন দেশের নেতা থাকবেন, কে থাকবেন না, স্নায়ুযুদ্ধের সময় সেটা বাইরে থেকে নির্ধারিত হতো অনেক সময়। সেই স্নায়ুযুদ্ধের আবার আবির্ভাব ঘটতে দেখতে পাচ্ছি। পরমাণুযুদ্ধের যে আশঙ্কা কিছুটা কমে গিয়েছিল, সেটার পদধ্বনি হয়তো শুনতে পাব। ফলে স্নায়ুযুদ্ধ এখন বিশ্বব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে। এটা ধনী-দরিদ্র সবাইকেই আঘাত করবে। তবে ধনী দেশগুলোর তুলনায় এটা দরিদ্র দেশগুলোকেই বেশি আঘাত করে।

সম্প্রতি শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সেই পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে। রাশিয়ার মতো অন্যতম পরাশক্তি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছে। তারা অনেকটা হঠাৎ করেই আক্রমণটা করেছে। এতে আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলো পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তারা এড়াতে পারেনি কিংবা চায়নি। তারা মনে করছে, এই যুদ্ধে রাশিয়া জয়ী হয়ে গেলে তাদের বৈশ্বিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা ঠিক যে এটা রাশিয়ার দিক থেকে একটা অপরাধ। কিন্তু চাইলে এই দেশগুলো মিলে এর সমাধান করতে পারত। চাইলে ইউক্রেন-রাশিয়া নিজেরাও সমাধান করতে পারত।

এখন যুদ্ধের তাত্ক্ষণিক একটা প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়বে এবং সারা বিশ্বের মানুষই তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই স্নায়ুযুদ্ধের বড় প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, যাতে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা আরো তীব্র হয়ে উঠতে পারে। এই স্নায়ুযুদ্ধ তীব্র হলে অর্থনীতিকে বেশি আঘাত করবে। বাংলাদেশ একটা উন্নয়নের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের মতো অনেক দেশই মোটামুটি উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে রয়েছে অনেকে। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন তাতে প্রভাব ফেলবে।

একটি দেশের শক্তির জায়গা দুটি। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্য; অন্যটি হচ্ছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্নায়ুযুদ্ধ দুটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একাট্টা হয়েছে। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও রক্ষা পাবে না। আবার এর ফল আমাদেরও ভোগ করতে হতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল ইউরোপ। তারা হয়তো সচেতনভাবে বাংলাদেশকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেবে না; কিন্তু সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের পণ্যের উৎসস্থলও পরিবর্তন হতে পারে। কারণ যখনই কোনো যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা থাকে, তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে যায়।

ইরানে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তাদের বহির্বাণিজ্য ৩০ শতাংশ কমে যায়; যদিও তাদের পেট্রলসহ নানা খনিজদ্রব্য আছে। ইরান একটা সমৃদ্ধিশালী দেশ এবং তার ৩০ শতাংশ বহির্বাণিজ্য কমে যাওয়া মানে অনেক ক্ষতি। এখন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। ইউক্রেনেরও তাই। এখন সেখানে যুদ্ধ হওয়া মানে তা সরাসরি ইউরোপের দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে আঘাত করবে। কারণ জার্মানিসহ অনেক ইইউ দেশের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ জ্বালানির উৎস রাশিয়া। আবার ইউরোপ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা আমাদের জনশক্তি রপ্তানিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কারণ আমাদের গন্তব্য দেশ মধ্যপ্রাচ্যও এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক লেনদেন কাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক লেনদেন পদ্ধতি সুইফটের সুবিধা থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক লেনদেনে পরিবর্তন আসবে। রাশিয়া বা অন্যরা বিকল্প ব্যবস্থা বের করবে। সবাই তো ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করবে না। কারণ রাশিয়ার অনেক মিত্র দেশ আছে। তারা অন্য ব্যবস্থায় যাবে। এর একটা উদাহরণ হলো ব্লকচেইন, বিট কয়েন। এরই মধ্যে বিট কয়েনের দাম বেড়ে গেছে, বিট কয়েন হলো ভার্চুয়াল মুদ্রা, যার দাম ৫০ থেকে ৬০ ডলার হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। যদিও বিট কয়েনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বীকৃতি নেই। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরাট প্রভাব আছে। ভার্চুয়াল মুদ্রা পশ্চিমা দেশগুলো খুব এটা ব্যবহার করে না।

মোট কথা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও লেনদেনের বিষয়গুলোর পরিবর্তন ঘটবে। এর রাজনৈতিক প্রভাব যত এড়ানো যায় ততই মঙ্গল হবে আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য। বাংলাদেশের উচিত হবে, নতুন পরিস্থিতিকে যতটুকু সম্ভব ইতিবাচক দিক থেকে নেওয়া এবং পর্যবেক্ষণ করা। এর জন্য প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের জন্য জরুরি। দেখা যাবে কী হয়, এমনটা করলে চলবে না। এখন থেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন