রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে তেমন বই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের কবি, লেখক, সাংবাদিকদের আসলে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
১৯৪১ সালে তরুণ মুজিব পশ্চিমবঙ্গের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কাছ থেকে দেখেন, তাঁর গান শুনেন; এর ৩০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই নজরুলকে প্রথম নিয়ে আসেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেওয়া প্রবাসী কবি পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতার দেশ পত্রিকায় লেখেন, ‘তিনি তখন পারি-সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ন্তগত ওরিয়েন্টাল ল্যাংগুয়েজ স্কুলে অধ্যাপনা করেন, ভারতীয় সংস্কৃতি বিভাগে। সুলভ মূল্যে ছাত্রদের পাঠ্য সাহিত্য পুস্তক প্রকাশার্থে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে একটা বই প্রকাশিত হয় তাঁর সঙ্কলিত, নাম- পয়েমস দো বাংলা দেশ, ১৯৭৩ সালের শেষে। বইটি উৎসর্গ করা হয় বঙ্গবন্ধুকে’ (সূত্র: দেশ, ২৭.০৪.১৯৯১ খ্রি.)। এমন মানের কাজ এ দেশের কেউ আজ পর্যন্ত বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে করেননি।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া শেষে কলকাতায় ফিরে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক মন্মথ রায় লেখেন-‘অদ্বিতীয় কীর্তির রুপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিজবুর রহমান এক একান্ত দর্শনে আমাদের ধন্য করলেন গত ২২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায়। …বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম অবলম্বনে লিখিত আমার দুইটি নাটক এক. স্বাধীনতার ইতিহাস, দুই. আমি মুজিব নই- দুইটি তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ দিয়ে ধন্য হতে পেরেছিলাম ‘ (সূত্র: সাহিত্যে তীর্থ বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমির ষাট বছর পূর্তিতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন-২০১৫ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা, পৃষ্ঠা-১২৮)।
নন্দিত ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায়কে দেশ’র সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখা একটা চিঠি থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এর প্রতিবাদ জানিয়ে একটা লেখা পাঠান অন্নদাশঙ্কর। লেখাটি কাটছাঁট করে ছাপাতে হতো বলে তা ছাপাননি সাগরময়।
১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট তিনি অন্নদাশঙ্করকে একটি চিঠিতে লেখেন- ‘…মুজিবের মৃত্যু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে সেন্সর আমাদের কাছে যে নির্দেশ পাঠিয়েছে, তাতে আপনার এই লেখা সেন্সরশিপের জন্য না পাঠিয়ে প্রকাশ করতে পারব না। আমি জানি, সেন্সর এই প্রবন্ধের বেশ কিছু অংশ কেটে বাদ দেবে। আপনি তা চাইবেন না, আমরাও তা চাই না। নিরুপায় হয়েই ফেরত পাঠাতে হলো’ (অন্নদাশঙ্কর রায়কে লেখা মননের পত্রালি, প্রথম আলো, ঈদ সংখ্যা-২০১২, পৃষ্ঠা- ৪৩৬)। বঙ্গবন্ধু হত্যার এ দেশের কোনো বুদ্ধিজীবী কী এমন সাহস দেখিয়েছেন?
ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্যামলী ঘোষ ‘দ্য আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে পিএইচডি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাসহ প্রকৃত তথ্যভিত্তিক বই এদেশের ক’জন লেখক লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়? বরেণ্য সাংবাদিক, ডেইলি স্টার’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম আলির ‘আফটার দ্য ডার্ক নাইট প্রোবলেমস অব শেখ মুজিবুর রহমান’ ছাড়া আর তেমন বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা যায় না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতিমধুর দিনগুলোর কথা কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু লিখেছেন ‘চীন দেখে এলাম’ নামের ভ্রমণালেখ্যে।
ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সম্মানেই পূর্ণতা পায় ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে আজ তুমি নাই, তুমি আছ মন বলে তাই…’ শিরোনামের গানটি। শ্যামল মিত্রের গাওয়া এ গান ‘অন্তরাল’ সিনেমায় সংযোজিত হয়, মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে।
সিনেমায় শুধু নয়, গানটিই তখন চার লাইনের ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, সঙ্গীতশিল্পী শ্যামল মিত্র। তাঁদের দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু ওই গান তাঁর প্রিয় জানিয়ে শ্যামল মিত্রকে বলেন, গানটির পূর্ণ রুপ দিতে।
বঙ্গবন্ধুর কথা শ্যামল মিত্র গানটির গীতিকারকে জানান। এরপরই গানটি পূর্ণ রুপ পায়। ষাট, সত্তরের দশকের কলকাতার পাঠকপ্রিয় বেশ কয়েক কবির কবিতায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি সেভাবে নেই। এ দেশের শক্তিশালী কবি শামসুর রাহমান, সাহিত্যের নানা শাখায় যিনি বিচরণ করেছেন। কতোজনকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, অথচ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর আলাদা কোনো কবিতা নেই।
আগামীকাল পড়ুন- বঙ্গবন্ধুর জাপানি বন্ধু ও ভক্তরা স্মরণযোগ্য।