ভারতকে বাদ দিলে জীবিতকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেশি বন্ধু ও ভক্তের সংখ্যা জাপানেই বেশি বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যেসব বিশিষ্ট জাপানি বঙ্গবন্ধুকে চিনতেন ও জানতেন; তাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর যথার্থ উত্তরসূরি জাতীয়তাবাদী বাঙালি হিসেবে।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবক প্রভৃতি পেশার খ্যাতিমান মানুষেরা। বিগত শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে জাপান-বাংলা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ভাববিনিময় সম্পর্কের শেষ উদ্যোগী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও ভাষাবিশেষজ্ঞ, বাংলাভাষাপ্রেমী অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি জাপান এবং সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যকার উজ্জীবিত সম্পর্ক এবং উন্নয়নমূলক সম্ভাবনার ভিতকে প্রবলভাবেই প্রকম্পিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এশিয়ার নতুন শিল্পোন্নত রাষ্টগুলো যথা দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের আগেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়িয়ে যেত। ১৯৭৩ সালে তাঁর জাপান সফর ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যা বাঙালির বহু বছরের অভীষ্ট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দুয়ার উন্মোচন করেছিল।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জাপানের উৎপাদনমুখী সৃজনশীল শিক্ষার প্রসার ঘটতো বাংলাদেশে। যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ কাঙ্ক্ষিত। উল্লেখ্য যে, তাঁর জাপান সফরের আগেই স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে ’নিহোন-বানরাদেশু কিয়েকাই’ তথা ’জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়শন’ গঠিত হয়েছিল টোকিওতে। যার চেয়ারম্যান ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী ও ডায়েট (সংসদ) সদস্য হায়াকাওয়া তাকাশি (১৯১৬-৮২)। শুধু তাই নয়, উপদেষ্টা ও পরিচালকরা ছিলেন জাপানের প্রথম শ্রেণির ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অত্যন্ত প্রভাবশালী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মালিক। তাঁরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গতিশীল নেতৃত্বের মাঝে এশিয়ার উন্নয়ন এবং জাপানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও দেখতে পেয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না।
১৯৭২ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাতোও এইসাকু তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং একাধিক সাংসদ নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পাঠান বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনীতির শিক্ষক তানাকা মাসাআকি। যিনি ছিলেন মহাবিপ্লবী বিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালখ্যাত (১৯৪৬-৪৮) আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের ঘনিষ্ঠ।
অন্যজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল ’এফ কিকান’ ফোর্স প্রধান এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। দলের নেতৃত্ব দেন সাংসদ ও প্রাক্তন শ্রম মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি। তাঁরা ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ১৯৭২ সালে।
আমরা অনেকেই জানি না যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম জাপানি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জাপান সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। জাপান-বাংলাদেশের শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মূলত হায়াকাওয়া কল্যাণে। তিনি বাংলাদেশকে এতোই ভালোবেসেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভস্মের একাংশ ঢাকার বৌদ্ধরাজিক মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়েছে তাঁর ইচ্ছানুসারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
হায়াকাওয়ার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ না হলেও তাঁর সহযোগী তানাকা মাসাআকির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। যাঁর শিয়রের কাছে সবসময় থাকতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দনরত একটি আলোকচিত্র। এতেই বোঝা যায়, শেখ মুজিব তাঁর কাছে কী রকম মানুষ ছিলেন!
প্রয়াত হায়াকাওয়ার মহীয়সী স্ত্রী হায়াকাওয়া মোতোয়ার সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল একাধিকবার। তিনি বঙ্গবন্ধু ও স্বামীর বন্ধুত্বকে কখনোই বিস্মৃত হননি। দুই দেশের সম্পর্ককে জোরালো করার জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। ঢাকার সোনার গাঁও হোটেলে হায়াকাওয়ার একটি স্মৃতিফলক খোদিত আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই তিনি টোকিওতে ’জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনে’র চেয়ারম্যান হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
আয়োজন করেছিলেন শোক সভার। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন সচিব, অধ্যাপক, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ী যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত এবং বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া মৃত্যু পর্যন্ত বন্ধুর শোক বিস্মৃত হননি। একটি নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথা তিনি লিখেছিলেন যেটা আমি আমার ’মানচিত্র’ কাগজে প্রকাশ করেছিলাম নব্বই দশকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানে জনমত ও তহবিল গঠনে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, হায়াকাওয়া ছাড়াও তাঁদের তালিকা দীর্ঘই হবে যদি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যায়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা, অধ্যাপক কাজুও আজুমা, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সাবেক প্রধান, আন্তর্জাতিক পতাকা গবেষক এবং লেখক ফুকিউরা তাদামাসা, প্রভাবশালী দৈনিক সানকেইশিম্বুন পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক তানাকা তোশিহিসা, এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তিব্বতী ছাত্র বর্তমানে অধ্যাপক, গবেষক এবং রাজনীতিবিদ ড.পেমা গিয়ালপো, খ্যাতিমান, রাজনীতিবিদ ইশিকাওয়া তামোন, নেতাজির সহযোদ্ধা ইতোও কেইসুকে প্রমুখের নাম করা যায়। যাঁরা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম বন্ধু ও ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী অধিকাংশই এখন আর জীবিত নেই।
বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলা ভাষাপ্রেমী অধ্যাপক ৎসুয়োশি নারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন জাপানি ভাষা শিক্ষা অনুষদ ১৯৭৪ সালে। জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক আজুমা মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বুকে ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড- তাঁকে এতোই বেদনাবিদ্ধ করেছিল যে বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অভিযুক্ত করে বলতেন, ’আপনারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী! কী অপরাধ তিনি করেছিলেন যে এরকম নৃসংশভাবে তাঁকে হত্যা করেছেন?’ অধ্যাপক নারা ও অধ্যাপক আজুমা দুজনেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দোভাষী। ১৯৭৩ সালেই তাঁরা পরস্পর বঙ্গবন্ধুর আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন।
প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপান প্রবাসী লেখক, রবীন্দ্রগবেষক।