আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন প্রজ্ঞাবান সূর্যমানবকে। যাঁর জন্মই হয়েছিলো জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করার মহান ব্রত নিয়ে। সদ্য-স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে তিনি সময় পেয়েছিলেন খুবই সামান্য। কিন্তু এই সামান্য সময়কেও তিনি অসামান্য করে তুলেছিলেন তাঁর সম্মোহনী জাদুতে। দূরদর্শী এই নেতা বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের মুক্তির পথ কোন দিকে। তাঁর দূরদর্শী কর্মকাণ্ড থেকে বাদ যায়নি বৃক্ষরোপণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও।
দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তিনি বৃক্ষরোপণের ওপরই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তাঁর এই উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশও ঘটেছিল নানাভাবে। স্বাধীন দেশে তিনি সবাইকে বৃক্ষপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গণভবন, বঙ্গভবন ও বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ লাগিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্য-স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো বৃক্ষরোপণ পক্ষ পালিত হয়। বৃক্ষরোপণ পক্ষ সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেন।
এই উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বরাত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাণী প্রকাশ করে দৈনিক বাংলার বাণী। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে দেশে দ্বিতীয়বারের মতো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালিত হয়। বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্বোধন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবনে নারকেল গাছের চারা রোপণ করেন। এ নিয়ে সমকালীন জাতীয় দৈনিকগুলোয় খবর প্রকাশিত হয়।
পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়- বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর আজ সকালে উত্তরা গণভবন প্রাঙ্গণে একটি নারকেলের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সেক্রেটারি তোফায়েল আহমেদ এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান কাজী গোলাম মোস্তফাও একটি করে চারা লাগান।
এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু সেদিন বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে উত্তরা গণভবন পরিবেষ্টনকৃত পুকুরের পাড়ে নারকেল গাছের চারা লাগানোর নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নির্মোহ পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা অনুভব করতে পারি, তাঁর উদ্ভিদ ও প্রকৃতিপ্রেম কতোটা গভীর ও সংবেদনশীল ছিল। জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বেশ কিছু গাছ এখনো বেঁচে আছে। নিজের হাতে গাছ লাগিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায়।
বলধা গার্ডেন ও ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উন্নয়নের জন্য তিনি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। চা-শিল্পের উন্নয়নের জন্য নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি উদ্ভিদের ব্যবহার করেছেন। তাঁর শাসনামলে সবুজ বিপ্লবেরও ডাক দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৭২ সালে রমনা মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে জুয়াখেলা বন্ধ করে তিনি নারকেল চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যান তৈরির উদ্বোধন করে উদ্যানটির নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন নগরীর কোটি মানুষের ফুসফুস সচল রাখতে সাহায্য করছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এই উদ্যানটির যে যাত্রা শুরু, তা এখন অনেকটাই বিস্মৃত।
প্রায় ২৪ বছর আগে, যখন বৃক্ষপ্রেমে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নারকেল গাছগুলো দেখে অনেকদিন ভেবেছি এই গাছগুলো কে লাগিয়েছেন? এই ভাবনা এতো জোরালো হওয়ার কারণ, কর্মসূত্রে প্রায় প্রতিদিনই একবার এই উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। আমার উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা আমাকে নিয়ে অনেক দিন এই উদ্যানে ঘুরে ঘুরে গাছ দেখেছেন। স্বাধীনতা স্তম্ভের সুদৃশ্য নাগেশ্বরগুলো তাঁর পরিকল্পনারই একটি অংশ।
বঙ্গবন্ধু কি জানেন তাঁর উদ্যানের সেই নারকেল গাছগুলো এখন ফলবতী হয়েছে? তাঁর নারকেলবীথির পাতায় পাতায় খেলা করে গ্রীষ্মের আলুথালু বাতাস, জোছনারাতে পাতার ফাঁকগলে নেমে আসে রূপালি আলোর ঝরনাধারা। আবার বিকেলের সোনারোদ পিছলে যেতে যেতে মায়াবী সন্ধ্যাগুলো ঘনিয়ে আসে। এভাবেই ঘনায়মান সন্ধ্যায়ও বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকেন স্মৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি নারকেল গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে তিনি একটি নারকেল গাছের চারা রোপণ করেন। ৫০ বছর বয়সী গাছটি এখন বেশ বড় হয়েছে। ফল ধরছে আরো কয়েক বছর আগে থেকেই। গাছটির চারপাশ ঘিরে রাখা হয়েছে কালো পাথরের বেদি দিয়ে। পাশে আছে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ মূর্তিও। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান খুলনা সার্কিট হাউজ মাঠে একটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। তারপর মহিলা কলেজ পরিদর্শনে এসে চারাটি রোপণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু গাছ লাগিয়েই থেমে থাকেননি, বৃক্ষ রোপণের ডাকও দিয়েছিলেন। তাঁর এই দূরদর্শী ভাবনা বর্তমান সময়ে এসে কতোটা যুগোপযোগী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি জানতেন, একটি ফলগাছ একসঙ্গে অনেক মানুষের বিচিত্র চাহিদা পুরণ করতে পারে। তা ছাড়া, ফল শুধু মানুষই খায় না, জীবজগতের বিশাল একটি অংশও ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার উদ্ভিদের জীবনচক্রের জন্যও ফল অপরিহার্য।
দেশের বৃক্ষায়ন, বৃক্ষসম্পদ রক্ষা, পরিচর্যা, গবেষণা, নান্দনিকতা, প্রচারণা, সর্বোপরি পরিবেশের সঙ্গে বনজসম্পদ ও বৃক্ষের সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সঠিক উপলব্ধি ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে। বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন বাংলার এই উর্বর পললমৃত্তিকার বুকে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি কাজে ও চিন্তায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন প্রাগ্রসর। চরম প্রতিকুলতায়ও আশাহত হননি। বিশ্বাস করতেন, ইতিবাচক মনোভাব কাজে লাগিয়ে সবকিছুই বদলে ফেলা যায়।
এর জন্য তিনি উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি দেশের মাটি ও প্রকৃতির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন কৃষি ও উদ্ভিদ বৈচিত্র দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা এখন যা ভাবছি, তিনি তা আরো অর্ধশতাব্দী আগেই ভেবেছিলেন। একজন খাঁটি বৃক্ষপ্রেমী ও প্রজ্ঞাবান নায়ক হিসেবেই তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
লেখক: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক।