পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে ভ্লাদিমির পুতিন ’জার্মানির নব্যনাৎসি’। তাঁকে ’নেতিবাচকভাবে’ প্রতিদিন বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করছে। প্রভাবশালী কয়েকটি পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের ‘খবরে’ বলার চেষ্টা চলছে- ’২৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মনে হয়েছে- দিনটা সুন্দর, ইউক্রেনে হামলা চালানো যাক।’ প্রকৃত সত্য তা নয়।
রাশিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমগুলো ‘অজ্ঞাতনামা’ সূত্রের বরাত দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘ডার্টি বম্ব’ বা পারমাণবিক বোমা তৈরির অভিযোগ করছে। এসব ‘সংবাদের’ দাবি, ইউক্রেন ওই ’বোমা’ তৈরির একবারে দ্বারপ্রান্তে ছিল। নানা শহরে হামলার জন্য ইউক্রেন নিজেই দায়ী। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে সেসব সংবাদমাধ্যমে ছিটেফোঁটাও নেই।
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের বিষয়ে ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে গুজব। আবার মূলধারার সংবাদমাধ্যমে যা আসছে না, তা-ও প্রায় সময় পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে সব সংবাদে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন পরিস্থিতির বিষয়ে ঠিক তথ্য জানার উপায় কী, সত্য সংবাদ জানা যাবে কোন মাধ্যম থেকে- এসব বিষয়ে মত ও পথের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, গবেষকরা।
সাংবাদিক, গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমনটি সবসময় ঘটে, তথাকথিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম একটি অবস্থান নেয়। তা রাষ্ট্রের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের অনেকে জানতেন, সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগ ঠিক ছিল না। কিন্তু তারা তা প্রকাশ, প্রচার করেননি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার গণমাধ্যম, যা সবচেয়ে মুক্ত বলে বিবেচিত, ইরাকে আক্রমণকে সমর্থন করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম একইরকম আচরণ করছে।‘
তিনি বলেন, ‘রুশ আগ্রাসন পশ্চিমের জন্য সরাসরি হুমকি, সেটা ইউরোপের জন্য। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বগুলো সমাধান না হওয়ায় যুদ্ধ- এ ধরনের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ লেখা অসম্ভব হবে সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য। গণমাধ্যম স্বাধীন হলে আর মানুষের মতামতকে অনুসরণ না করলে পাঠক, দর্শকরা তাকে অনুসরণ করবে না। বিজ্ঞাপনও কমে যাবে। তারা তা না করলে গণমাধ্যম ব্যর্থ হবে। তারা এখন জনমতে বন্দি। এই চরম পর্যায়ে জনসাধারণের তথ্য জানার স্বাধীন কোনো উৎস নেই। সামাজিক মাধ্যম ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক মাধ্যমে আমরা ঠিক তথ্য পেতে স্বাধীন গোষ্ঠীগুলোর সন্ধান করতে পারি।’
গবেষক ইসরাইল খান বলেন, ‘আমার বুদ্ধি দিয়ে সত্য বের করতে চেষ্টা করবো। কারণ, সবাই তার স্বার্থের, লাভের জন্য কাজ করবে, আমিও করি, বা করবো। এটা মাথায় রাখলেই সত্য বোঝা কষ্টকর নয়। আমি তো নিজে কোনো গণমাধ্যম চালুর যোগ্যতা রাখি না। সত্য হলো- সারভাইবাল অব দ্য ফিটেষ্ট।’
লেখক, গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম শিকার সত্য। যে কোনো যুদ্ধের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও জেনেছি। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বেতার ও পত্রিকার প্রচার থেকে তখনকার পাকিস্তানের মানুষরা জানতাম, ভারতই আক্রমণকারী! পাকিস্তানের বীরসেনানীদের প্রতিরোধ ও অগ্রগমনের মুখে ভারতীয়রা পর্যুদস্ত। দিল্লির লালকেল্লায় পাকিস্তানি পতাকা উড়লো বলে! একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার ও তাদের প্রচারমাধ্যমের উল্টো প্রচারের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরাট অংশ বুঝতেই পারেনি দেশটার পূর্বাংশে আসলে কী ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তারা জেনেছেন ভারতীয়দের অন্তর্ঘাত হিসেবে। ভেবেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাফল্যের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও দেখা গেছে, আমেরিকার মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি, সেখানে যে মার্কিন ও তাদের সহযোগী বাহিনী ভিয়েতনামীদের হাতে ক্রমাগত মার খাচ্ছেন। এসব অভিজ্ঞতা মনে রেখে, আমাদের চোখকান খোলা রাখতে হবে। পক্ষ-বিপক্ষ সবার সব খবরই শুনবো। কিন্তু পুরোটা কখনো বিশ্বাস করবো না। নিজেদের বাস্তববুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞান, বিবেচনাবোধ কাজে লাগাবো।’
লেখক জাকির তালুকদার বলেন, ‘পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, ইউক্রেন, ন্যাটো- সবাই তো পুঁজিবাদী। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ইয়েলিৎসিন যেভাবে মার্কিনের বশংবদ ছিলেন, পুতিন তাঁর তুলনায় একটু বেশি রুশ জাতীয়তাবাদী। তবে সমাজতান্ত্রিক কখনোই নন। তিনি নব্বই পূর্বকালীন পরাশক্তির অহংকার ধরে রাখতে চান। সেই কারণে একদা অঙ্গরাজ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর খবরদারি করেন। তাছাড়া তিনি অস্ত্র ব্যবসাতে আবার মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চা়ন। আমেরিকাও তাঁকে ঘিরে রাখতে চায় ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করে।’
তিনি বলেন, ‘আমেরিকার সমর্থক পুঁজিবাদী সংবাদমাধ্যম তাদের অনুকূলে প্রচারণা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বামমনাদের তো অন্তত পুতিনকে নির্বিচারে সমর্থন করার নৈতিক কারণ নেই। আমি বলি, কোনো দুর্বল ও ছোট দেশের ওপর আক্রমণ করার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর সব দুর্বল দেশকে আতঙ্কিত করে তোলা। আমাদের দেশের মানুষ যেমন ভারতকে নিয়ে আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। কোনো মিডিয়াকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেনের নিরাপত্তার দাবি তোলা দরকার। একইসঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর উস্কানিমূলক আচরণ বন্ধের দাবিও তোলা দরকার।’
কবি মারুফ রায়হান বলেন, ‘যুদ্ধের ফলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা উপকৃত পক্ষগুলো নিজ গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত বা সত্যগোপনের নীতি থেকে নানামুখি সংবাদ পরিবেশন করে, এটি সত্য। ইতোপূর্বে সংঘটিত যুদ্ধ, আগ্রাসনের ঘটনা থেকে বিশ্ববাসীর তেমন অভিজ্ঞতাই হয়েছে। ফেসবুক বিচিত্র মানুষের বাজার। এখানে বিচিত্র সত্যাসত্য, তথ্য ডালপালা মেলবেই। আগ্রাসনের সর্বসাম্প্রতিক স্থিরচিত্র ও সচলচিত্রের দিকে চোখ রাখলে এবং ইতিহাস বিষয়ে অবগত থাকলে সত্য জানা সহজতর হবে। এজন্যে বিশ্লেষণমূলক লেখাই বেশি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।’
চিত্রশিল্পী নাজিব তারেক মনে করেন- ’অক্সফোর্ড অভিধান, উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- গণমাধ্যম মানে সরকার বা মালিকপক্ষ যা বলতে চায়, তা বলবার মাধ্যম। গণমাধ্যমে সত্য সন্ধানটি তাই ভুল চাওয়া। তাহলে কি গণমাধ্যম সত্য বলে না? বাংলা বাগধারা আছে- যা রটে তার কিছুটা বটে। জনপ্রিয়, ব্যবসা সফল হতে তাই আধুনিক গণমাধ্যম সাহিত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার উপর জোর দেয়। যুদ্ধাবস্তায় এ বস্তনিষ্ঠতা আশা করা যায় না। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যম তাদের কথা বলছে। রুশ গণমাধ্যম তাদের কথা বলছে। বুদ্ধিমান ও শিক্ষিতজনরা এর মধ্য থেকেই বস্তনিষ্ঠ সত্য বুঝে নেবেন, বাকিরা যে যার মত রূপকথা শুনতে থাকবেন।’
কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি আরো একটি বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সেটি হচ্ছে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা। সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে পৃথিবীর যেখানে যা ঘটছে- যথাযথভাবে তা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা। ইউক্রেন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা গণমাধ্যম অনেকটা ঘোষণা দিয়ে একটি পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। পশ্চিমের সরকার প্রধানরা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সব ধরনের প্রচারকেই প্রোপাগান্ডা হিসেবে ঘোষণা করে তার প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম তাতে পুরোপুরি সম্মতি দিয়েছে। তারাও পশ্চিমের স্বার্থের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।’
তাঁর মতে, ‘পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে সত্য তথ্য এ মুহুর্তে অন্তত তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। সমাজতন্ত্র শাসিত রাশিয়ার গণমাধ্যম পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রিত- এটি পুরনো কথা। ফলে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে তারাও সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরছে না। তারাও সুবিধাজনক, খণ্ডিত তথ্য প্রচার করছে। এ অবস্থায় সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিনই হয়ে গেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের জন্য সেটি আরো কঠিন হয়ে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নাগরিকরা কীভাবে সঠিক তথ্য পাবেন- প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ দেশের পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ আন্তর্জাতিক খবর পায়, সেগুলোর উপর নির্ভরও করে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হবে পাঠকদের কাছে সঠিক খবর পৌঁছে দেওয়ার। দেশের সংবাদমাধ্যমের পক্ষে কী তা সম্ভব? এখানে সংবাদমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের সক্ষমতার প্রশ্নটি আলোচনায় চলে আসে। পাঠক, দর্শক হিসেবে আমি নিজে দুই ঘরানার গণমাধ্যম থেকে সঠিক তথ্যটা বাছাই করে নেওয়ার চেষ্টা করি। দুইপক্ষের সংবাদমাধ্যমে মূল খবরের ভেতরে কোথাও না কোথাও বাস্তব পরিস্থিতির চিত্রটা থাকে। প্রপাগান্ডার রঙের ভেতর থেকে সেই অংশটুকু আলাদা করে নিতে হয়। সাধারণ পাঠকদের পক্ষে খুঁজে নেওয়ার কাজটি করা কঠিন।’
প্রবাসী লেখক, রবীন্দ্রগবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার বলেন, ‘তথ্য বা সংবাদ সংক্রান্ত বিভ্রান্তির মূল কারণ হচ্ছে, ইতিহাস না জানা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতার শিকার পুরো ইউরোপ, ইউক্রেন সেই প্রতিযোগিতার শিকার মাত্র। বিষয়গুলো বুঝলেই কোন সংবাদ সঠিক বা মিথ্যা এর পেছনের পটভূমিটা পরিষ্কার হতে পারে। সাধারণ আমজনতা ইতিহাস জানে না। তাই তাদের বিভ্রান্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, দায়িত্বশীল পত্রিকাগুলোর সংবাদ বিশ্লেষণ ও উপসম্পাদকীয় পড়াই উত্তম। তাতে সময় বাঁচবে, বিভ্রান্তিও কমবে।’