দেশের বাজারে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই
ফাইল ছবি

রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের ডামাডোল দুই দেশের সীমানা পেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে পুরো বিশ্বে। বাংলাদেশের বাণিজ্য আকাশেও জমতে শুরু করেছে কালো মেঘ। কৃষ্ণসাগরের পাড়ে যে গোলাবারুদ পুড়ছে, সেটার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে। বিশেষ করে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর, সেগুলোর দাম এরই মধ্যে চড়েছে। বেড়েছে নির্মাণ উপকরণ, জ্বালানি পণ্যের দামও। আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে অন্য পণ্যের দামও এখন ‘পাগলা ঘোড়া’।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ও পড়ছে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব। বিদেশে পণ্য পাঠানোর জন্য জাহাজ মিলছে না। কোনো কোনো ক্রেতা নিচ্ছে না পণ্য ডেলিভারি। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থগিত হয়ে গেছে লেনদেন। এতে পাওনা টাকা পাচ্ছেন না রপ্তানিকারকরা।

universel cardiac hospital

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে পরোক্ষ প্রভাব বেশি। কারণ, এ দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি ব্যবসা খুব বেশি নেই। বাংলাদেশ প্রধানত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে। এই আমদানিরও বড় অংশ আসে অন্য দেশের সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। দেশের মোট গম আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে এ দুই দেশ থেকে। আসে পোলট্রি মুরগি, মাছ ও গবাদি পশুর খাবার সয়ামিল। এ ছাড়া আমদানি হয় সামান্য কিছু বিভিন্ন জাতের ডাল ও সরিষা। আমদানি হয় কিছু রাসায়নিকও। সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কারিগরি অনেক যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয় রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের প্রভাবে সবকিছুতে বাড়ছে শঙ্কা।

অন্যদিকে, ইউক্রেন রড ও স্টিলের কাঁচামাল স্ট্ক্র্যাপের বড় সরবরাহকারী। বাংলাদেশও কিছু আমদানি করে। সূর্যমুখী তেলের বড় সরবরাহকারী রাশিয়া। বলা যায়, পণ্যটির সরবরাহ বন্ধ। এতে বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও অন্য ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়ে দামেও প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসেরও বড় সরবরাহকারী রাশিয়া। ইউরোপের অনেক দেশের গ্যাসের প্রধান সরবরাহকারী রাশিয়া। এই যুদ্ধের কারণে দেশ দুটি থেকে সরাসরি রপ্তানি বন্ধ হয়েছে। দেশ দুটির সরাসরি আমদানিও বন্ধ। পাশাপাশি এর প্রভাবে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে উঠেছে। গতকাল সোমবার বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ঠেকেছে ১৪০ মার্কিন ডলারে, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে শিল্পোৎপাদন ও পরিবহন ভাড়ায়। জাহাজ ভাড়া গত ১৫ দিনে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই দুই দেশ এবং পাশের অন্য দেশের বন্দরে আন্তর্জাতিক পথে চলাচলকারী জাহাজ সংস্থাগুলো পণ্য পরিবহন স্থগিত করেছে।

আন্তর্জাতিক শিপিং লাইন মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি), মার্কস, সিএমএ সিজিএমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিপিং লাইন ইউক্রেন ও তার আশপাশের দেশের বন্দরে পণ্য নিয়ে যাওয়া স্থগিত করেছে। সিঙ্গাপুরের ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস নামে শিপিং লাইন কৃষ্ণসাগর এলাকায় যেসব বন্দর আছে, সেখান থেকে নতুন করে কনটেইনার পরিবহনের অর্ডার নেওয়া স্থগিত করেছে। ২ মার্চ বাংলাদেশি জাহাজে আক্রমণের পর ন্যাটো যারা বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনা করে, তাদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।

দেশের বাজারে প্রভাব

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের বাজারে বেড়েছে গম ও আটার দাম। ২০ দিনের ব্যবধানে ময়দার দাম কেজিতে প্রায় ১৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ময়দা ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আটার দামও বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। ভোজ্যতেলের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। দেশের অনেক বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেল মিলছে না। যদিও সয়াবিন ও পাম তেল রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে আমদানি হয় না। ওই দুটি দেশের পরিস্থিতির কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। আবার রাশিয়া থেকে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে সয়াবিনের চাহিদা বেড়েছে। দুইয়ে মিলে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে ছোলার দামও। রমজানে পণ্যটির দাম নিয়ম মেনে এমনিতেই বাড়ে। তবে রমজানের এক মাস আগেই ইফতারির এই অন্যতম অনুষঙ্গটির দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বেড়েছে নির্মাণ খাতের অন্যতম উপকরণ রডের দামও। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্ববাজারের স্ট্ক্র্যাপের বড় সরবরাহকারী। আবার উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য দেশের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যটির দাম ১০ দিনের ব্যবধানে টনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মান ও গ্রেডভেদে বর্তমানে প্রতি টন রড ৭২ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি পরিবহন খরচ বেড়েছে। আবার ভবিষ্যৎ চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে দাম বাড়ছে।

রান্নার গ্যাসের দামও বেড়েছে। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না গ্যাসের সিলিন্ডার। ওজনভেদে প্রতি সিলিন্ডারের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব

বাংলাদেশ থেকে রাশিয়াতে যে রপ্তানি হয়, তার বড় অংশ তৈরি পোশাক। বর্তমানে তুসকা গ্রুপসহ দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার জন্য পোশাক তৈরি করছে। এই পোশাক শেষ পর্যন্ত কবে রপ্তানি করতে পারবে, তা অনিশ্চিত। আবার গ্রিন লাইফ নিটটেক্সের মতো যারা পণ্য রপ্তানি করে এখনও মূল্য পাননি, তারাও কবে নাগাদ তা পাবেন- সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ, রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। আবার সুইফট লেনদেনও স্থগিত।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ রেখেছে। এসব দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ অন্য পণ্য নিয়ে রাশিয়াতে রপ্তানি করত। তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম ও ইন্ডিটেক্স রাশিয়ার বাজারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পণ্য তৈরি করে নেয়। সেই ব্যবসাও এখন অনিশ্চিত। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, প্রধান প্রধান শিপিং লাইন রাশিয়া ও ইউক্রেনের বন্দরে পণ্য পরিবহন না করার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের অন্যান্য বন্দরেও অনেক জাহাজ কোম্পানি যেতে চাইছে না। এতে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হবে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তাদের মিত্ররা। এদিকে, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ফেডএক্স ও ডিএইচএলের উড়োজাহাজের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাশিয়া। এই দুটো কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলসি ডকুমেন্ট আনা-নেওয়া করা হয়। রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন বেশি সময় লাগছে। এতে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াও দেরি হচ্ছে। যদিও অ্যারাম্যাক্স নামে আরেকটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে ডকুমেন্ট আনা-নেওয়া করছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে গত রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে এরই মধ্যে এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এবং ভবিষ্যৎ ব্যাপক অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জ্বালানি তেল, গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেছে এবং মূল্যস্ম্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে। এই যুদ্ধ করোনার সংকটে থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলেছে।

শেয়ার করুন