কর্মস্থল থেকে সংবাদের ঘটনাস্থল, বা অনুষ্ঠানস্থল। বাসা থেকে কর্মস্থল, ফের বাসায়। কর্মস্থল থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ (ডিইউজে) সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার অন্যান্য সংগঠনের কার্যালয়। প্রতিদিন এভাবে চলাচলের পথে নারী সাংবাদিকদের চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা, নিগ্রহের চিত্র। কখনো কখনো নিজেই শিকার হন। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর জন্য রয়ে যাওয়া অসভ্য আচরণের। ঘরের বাইরে নগরের পথে-ঘাট, রাজপথ থেকে অলিগলি, গণপরিবহন, কর্মস্থলে যে ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনা চোখে পড়ে নারী সাংবাদিকদের, সেসব কথা তাঁরা মত ও পথের কাছে বলেছেন নিজের ভাষায়।
যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ টুডের বিশেষ প্রতিনিধি সাজেদা পারভীন বলেন, ‘গতানুগতিক বিভিন্ন বাধার সঙ্গে নারীর জন্য নতুন যোগ হয়েছে ডিজিটাল নির্যাতন। নারী সাংবাদিকদেরকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ ওয়েবসাইটের মন্তব্য থেকে শুরু করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নারী সাংবাদিকরা প্রতিদিন ভার্চুয়ালি একধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হন। যা তাদের পেশাগত, ব্যক্তিগত জীবনের অংশে আক্রমণ করে। মানসিকভাবে আঘাত করে। এতে পেশাগতভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। এগুলোর সঙ্গে কখনো কখনো নারী সাংবাদিক হত্যারও যোগসূত্র থাকে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। সাইবার অপরাধ থেকে নারীকে রক্ষা করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি। জনসচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই।’
সারাবাংলাডটনেটের বিশেষ প্রতিনিধি ঝর্ণা রায় বলেন, ‘সাংবাদিকতায় আমি নারী হিসেবে যুক্ত হইনি। হ্যাঁ, ঘর থেকে বের হলে মানুষ আমাকে নারী হিসেবে দেখেন মানুষ। পেশা কী, কোথায় কাজ করি, চরিত্র ইত্যাদির কথিত প্রশ্ন আসে পরে। গলির মুখে, বাসস্ট্যান্ডে রিক্সার জন্য কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। আশপাশে চলাচল করা লোকগুলোর চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, চোখ দিয়েই বুঝি গিলে খাবেন! আধুনিক পোশাক-আশাক পরনে থাকলে তো কথাই নেই! তাকানোর পাশাপাশি মুখে যে যা পারেন, বলে সরে পড়েন। বাসে আরেক দফা এসবের মুখোমুখি হতে হয়। এই হলো নারীর প্রতিদিন রাস্তায় চলাচলের গল্প। এ পরিস্থিতি সামলে কর্মস্থল যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এর জন্য অনেকটা দায়ী নিজ পেশার সহকর্মীরা।’
তাঁর মতে, ‘গুটিকয়েক, বা তার চেয়েও কম সহকর্মীর প্রতিহিংসা কখনো কখনো নারীকে পেশা বদলে বাধ্য করে। এটা মানসিক নির্যাতন। যা অনেকে প্রকাশ্যে বলতে পারেন না, প্রতিবাদ করতে পারেন না। অবশ্য আমার কাজের বাইরে ওসব আজেবাজে চিন্তা করার সময় নেই। বরাবরই সাংবাদিক হতে চেয়েছি। চ্যালেঞ্জ সব পেশাতে কম-বেশি রয়েছে। হয়তো সাংবাদিকতায় একটু বেশি। নারী হলে আরো বেশি। কর্মস্থলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারলে রাস্তাঘাট, পরিবহনে ঘটে যাওয়া সংকটগুলো সমস্যাই মনে হবে না।’
নাগরিক টিভির প্রধান প্রতিবেদক শাহনাজ শারমীন জানান, ‘নারী যে কোনো কাজ করতে পারেন, তা তাকে দুইবার প্রমাণ দিতে হয়। একবার তিনি পারেন, আরেকবার নারী হিসেবে পারেন। তবুও তিনি পারেন, শেষ পর্যন্ত পারেন। সবসময় মনে হয়, একজন কর্মজীবি নারী দুটি চাকরি করেন সমান্তরালে। একটি কর্মস্থলে, অন্যটি তার বাসায়। একজন নারী জিতলে সব নারী জিতে যান। কারণ, তখন অন্যদের জন্য পথ তৈরি হয়।’
একাত্তর টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিন ভাবনাগুলো প্রকাশ করেন এভাবে- ‘শিক্ষিত নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিহিংসা কাজ করে। পুরুষের কর্মক্ষেত্র, আয় উন্নতিতে ভাগ বসানো কর্মজীবী নারীদের প্রতি এ প্রতিহিংসা দ্বিগুণ হয়ে উঠে। কর্মজীবী নারীর পথ থেকে কর্মক্ষেত্র- সবখানে যৌন হয়রানি, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, অধিকারে বৈষম্য হয়ে উঠে জীবনের বাস্তবতা। এর চর্চা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষের পাশাপাশি একই মানসিকতার নারীরাও করেন। অবশ্য এ অচলায়তন ভেঙে অনেকে বেরিয়ে আসছেন।’
তিনি বলেন, ‘নারী সাংবাদিক, বা সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা নারী সাংবাদিকদের বাস্তবতা সমাজের আর দশজন নারীর মতোই। পরিবর্তন আনতে এ পেশায় দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে চলছেন তারা। সংগঠন, কর্মক্ষেত্র, রাস্তা- সবখানে নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষের সক্রিয় ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনে নারী সাংবাদিকদের বাড়তি ঝুঁকি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি সহযোগিতা, ভূক্তভোগী হলে আইনি সহায়তা দরকার। নির্যাতনের মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। নারী-পুরুষের চিন্তা, আচরণ পরিবর্তনে দরকার কাউন্সেলিং ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।’
দীপ্ত টিভির ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ দিলশাদ জাহান এ্যানী মনে করেন, ‘বাসে যাতায়াত করা নারীরা হয়রানির শিকার হন নানাভাবে। কোথাও সারিতে দাঁড়াতেও তারা বৈষম্যের শিকার। সম্প্রতি একটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দেখলাম, তিনটি সারি পুরুষের, নারীদের জন্য একটি। সমতার প্রশ্নে দরকার ছিল নারী-পুরুষের দুটি করে সারি। সমতার কথা বলা হলেও অনেকক্ষেত্রে তা বাস্তবে নেই। পথে, ফুটপাতে যারা থাকেন, মাঝেমধ্যেই দেখা যায় পুরুষের মারধরের শিকার হচ্ছেন। নারীর অধিকার আসলে কী- সেটা অনেক নারীই জানেন না। তাদের মধ্যে অধিকারবোধ জাগাতে হবে। আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষদের মন মানসিকতার পরিবর্তন কীভাবে করা যায়, ভাবতে হবে। সবাই মিলে প্রতিকার সম্ভব। প্রতিক্রিয়াশীল স্বভাবের পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।’
নিউজনাউবাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফারজানা আফরিন মত ও পথকে বলেন, ‘নারীর চ্যালেঞ্জ ঘর থেকে শুরু। কর্মজীবী নারীদের অবস্থা আরো সঙিন। সময় ব্যবস্থাপনা করে সব গুছিয়ে ঠিক সময়ে প্রতিদিন কর্মস্থলে পৌঁছানোর মানসিক চাপ। বাইরে এসে অসহনীয় যানজটের নগরীতে গণপরিবহনের জন্য অনির্ধারিত সময় ধরে অপেক্ষা। সময়মতো পাওয়া গেলেও বাসে উঠতে পারা, না পারার সংগ্রাম। চালক, সহকারীদের থেকে প্রায়ই শুনতে হয়- মহিলা সিট (আসন) খালি নেই। সীমিত সংখ্যক সংরক্ষিত আসন, যা পাওয়া অতি দুষ্কর। দাঁড়িয়ে যেতেও প্রতিনিয়ত নিপীড়নমূলক স্পর্শ, তির্যক মন্তব্য ইত্যাদির মুখোমুখি হতে হয়। এ মানসিক চাপ, অস্থিরতা নি:সন্দেহে নারীর কর্মস্পৃহায় প্রভাব ফেলে, কাজের নিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটায়।’
তিনি বলেন, ‘আজকাল গণপরিবহন, সড়কে নারীর একলা চলাচলে ব্লেড দিয়ে জামা কেটে দেওয়া, গায়ে হাত দেওয়ার প্রতিবাদ করলে তাকে দলবদ্ধভাবে শারীরিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করার মতো নানা ধরনের সংবাদ আসছে গণমাধ্যমে। নারীদের জন্য আলাদা পরিবহন, পর্যাপ্ত সংরক্ষিত আসন এ সমস্যার যতোটা না সমাধান করবে, এর চেয়ে বেশি জরুরি সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনে যথাযথ ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়া। তৃণমূল থেকে মূলধারা- সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ চিহ্নিত করে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে বিভিন্ন কাউন্সেলিং ও এওয়ারনেস বিল্ড আপ জরুরি।’
দৈনিক ইত্তেফাকের নিজস্ব প্রতিবেদক মোরশেদা ইয়াসমিন পিউ বলেন, ‘গণপরিবহনের সাধারণ চিত্র নারীকে ধাক্কা দেওয়া। তার শরীরে হাত দেওয়া। উঠতে না দেওয়া, উঠলেও অশালীন ধাক্কা, অশ্লীল মন্তব্য। অনেক নারীর তিক্ত এ অভিজ্ঞতা আছে। যা কোনো নারীকে দীর্ঘ সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রাখে। এসবের প্রতিকারে নারী-পুরুষকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে পুরুষদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে। এক পুরুষ অন্য পুরুষের অভব্য আচরণের প্রতিবাদ করলে এর অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দ্রুত জরিমানাসহ কিছু শাস্তির বিধান থাকলে গণপরিবহনে চলাচলে নারীর হয়রানির প্রতিরোধ সম্ভব।’
নিউজনাউবাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফারহানা নীলা বলেন, ‘কর্মস্থল থেকে শুরু করে ঘরের গৃহিণী, প্রতি স্থলেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন নারীরা। শৈশব থেকে আমার পাঁচ বান্ধবী, তাদের মধ্যে চারজনই এখন তালাকপ্রাপ্ত। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে হয়েছে। কর্মস্থলেও নিজের সহকর্মীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হয়রানি শিকার হচ্ছেন নারীরা। সমাধানে দরকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তা একদিনে সম্ভব নয়।’
বিটিভির প্রতিবেদক তুলনা আফরিন বলেন, ‘আমি সংবাদকর্মী। নারী নই, মানুষ। কর্মস্থলে একজন পুরুষের থেকেও কোনো অংশে কম কাজ করি না। হিসাব করলে বেশিই হবে। কর্মস্থলে গেলে আমি কখনোই কর্মঘণ্টা গুনি না। দায়িত্বকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই। পথেঘাটে চলাচলের সময় এখনো প্রায়ই ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিছু লোকের দৃষ্টিভঙ্গি কখনো ঠিক হবে না। কারো ভরসায় না থেকে নারীকে নিজের সমস্যাগুলো নিজেই প্রতিহত করতে হবে।’
ডিবিসির নিজস্ব প্রতিবেদক ফারহানা ইয়াছমিন জুঁথী মত ও পথকে বলেন, ’নারীর উন্নয়নে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রমাণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্পষ্ট। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আসলে কতোটা বাস্তবায়ন হয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে, বা বেসরকারিভাবে তদারকি হয়? গণপরিবহনে বাসা থেকে কর্মস্থলে যাই, কর্মস্থল থেকে বাসায় আসি। সকালবেলা হলে বাসের সহকারীরা নারী বলে বাসে উঠায় না। বেশিরভাগ সময় বাস পুরুষদেরকে নিয়ে দ্রুত চলে যায়। আসন পূর্ণ হয় পুরুষ যাত্রীতে। নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনেও পুরুষেরা বসে থাকেন। পরিবারে মেয়েদের সম্মান করলে গণপরিবহনে, রাস্তায় নারীরা হয়রানির শিকার হবেন না।’
গণমাধ্যমকর্মী ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা ইভ বলেন, ‘পত্রিকার পাতায় আজ নারীর জয়গান। পুরোটা কাগজ ঘাটলে খুব কম পৃষ্ঠা পাওয়া যাবে, যেখানে নারীর কথা লেখা নেই। একদিনের অনুপ্রেরণায় বাকি তিনশত চৌষট্টি দিন চলা যায় না। বিসিএস ক্যাডার এক নারী সম্প্রতি ফেসবুকে লোমহর্ষক কাহিনি লিখলেন সিএনজিতে ঘটে যাওয়া তথ্য দিয়ে। আমরা তাহলে বাকি দিনগুলো কিভাবে অতিক্রম করি? সুস্থ মানসিকতার অভাবেই মূলত এসব কর্মকাণ্ড ঘটছে পৃথিবীজুড়ে। পুরুষের শিক্ষিত হওয়াটা কম জরুরি। মানুষ হওয়াটা প্রয়োজন বেশি।’
বি:দ্র: ছবি ও বক্তব্য জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে দেওয়া হয়নি।