‘বিতর্কিত’ যে বই ক্লারা জেটকিনের সংগ্রাম এগিয়ে নেয়

হাসান শান্তনু

‘আমাদের শরীর, আমরা’ (আওয়ার বডিজ, আওয়ারসেলভস) শিরোনামে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত একটি বই পুরো পৃথিবীর নারী স্বাধীনতায় বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। যা লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক নারী। তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী চিন্তাধারার, সমাজতান্ত্রিক। তাঁরা তখন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত ছিলেন। বইটি ছিল নারীদের যৌনজীবন, যৌনতা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের বিষয়ে তথ্য, খোলামেলা আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ওই সময়কে যদিও বলা হচ্ছিলো ‘নারীদের যৌনতার মুক্তির যুগ’। কিন্তু তখনো অসংখ্য নারী নিজের শরীর সম্পর্কে খুব কমই জানতেন।

যৌনস্বাস্থ্যের বিষয়েও তাদের খুব কমই জানা ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে তখন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি আসতে শুরু করে। তবে সন্তান জন্ম দেওয়া, না দেওয়ার বিষয়ে তখনো পুরুষের সিদ্ধান্তই ছিলো মূখ্য। ‘আমাদের শরীর, আমরা’ বইটি ছিলো নি:সন্দেহে বৈপ্লবিক, দ্ব্যর্থহীন ও আন্তরিক। প্রকাশিত হওয়ার অল্পদিন পরই ৩৩টি ভাষায় তা অনুদিত হয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ‘ইভানজেলিক্যাল’ বা মৌলবাদী এক খ্রিষ্টান বইটিকে ‘অশ্লীল, আবর্জনা’ অ্যাখ্যা দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগারে সেটাকে তিনি নিষিদ্ধের দাবি জানান। তাঁর দাবি মেনে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান বইটিকে নিষিদ্ধও করে।

পুঁজিবাদী, রক্ষণশীল সমাজে নারীর ব্যক্তিগত, যৌন স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়ে নেয় বইটি। সেটা ওই সময় ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়। তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। বইটি ‘বেস্টসেলার’ হয়েছিল। পরিণত হয়েছিল একটি সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায়। এটা ছিল নারীদের দৈহিক গঠন, যৌন অনুভূতির বিষয়ে নানা তথ্যে ভরা একটি বিশ্বকোষের মত। ওই বইয়ের লেখকদের অন্যতম জোয়ান ডিৎজিওনের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক জোসেফিন ক্যাসার্লি ।

জোয়ান ডিৎজিওন জানান, ‘প্রথম দিকে তারা ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না, এ বিষয়ে একটি বই বের করা ঠিক হবে কীনা। ব্যাপারটা একটা বাণিজ্যিক উদ্যোগের মতো শোনাচ্ছিল।’ নারী ও নারীর দেহ নিয়ে লেখা এ বই ইতিহাসের সাক্ষী হলেও একে নিয়ে বিতর্কও কম নয়। তবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ক্লারা জেটকিনের সংগ্রাম, লড়াইকে বইটি এগিয়ে নেয়, এটা সবাই স্বীকার করেন। শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্তের নাম ক্লারা। এ মহীয়সীর নেতৃত্বেই সংগঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেন তিনিই।

ক্লারা ছিলেন জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী। ১৯০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তাঁর নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধির অংশ নেওয়ার মাধ্যমে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ওই সম্মেলনেই পরের বছর থেকে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব আসে।

সেই থেকেই ধীরে ধীরে ৮ মার্চ দিবসটি বিভিন্ন দেশে নারী অধিকারের প্রতীকে পরিণত হয়। অনেক দেশই সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয় দিবসটিকে। অনেক দেশ দিনটি নারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে পালন করে থাকে।

নারীবিষয়ক বই নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিশ্বসাহিত্যে আরো আছে। এ দেশেও ঘটেছে। বহুমাত্রিক লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটি ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর বিএনপির সরকার নিষিদ্ধ করে। এর প্রায় সাড়ে চার বছর পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০০ সালের ৭ মার্চ উচ্চ আদালত বইটির নিষিদ্ধকরণ আদেশ বাতিল করেন। বইটি পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে ‘আগামী প্রকাশনী’ সংস্থা থেকে। ১৯৯২ সালে ঢাকার একুশে বইমেলাতে ’নদী প্রকাশনী’ থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

শেয়ার করুন