সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার: অভিন্ন আইন প্রণয়নে সরকার ‘ঝুঁকি’ নেয় না কেন?

হাসান শান্তনু

ইসলাম, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট- চারটি প্রধানসহ অন্য ধর্মের অনুসারীদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন। দাবি উঠেছে আশির দশক থেকে। এরপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এ সময়ের মধ্যে কোনো সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যােগ নেয়নি। এমনকি দাবিগুলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে তেমন কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। আইন প্রণয়ন করলে সব ধর্মের কট্টরপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীলদের ভোট হারানোর আশঙ্কা থাকে। এসব বিবেচনায় কোনো সরকারই ‘ঝুঁকি’ নিতে চায়নি। এ রকম আইন না থাকায় বাবা-মা, স্বামীর সম্পদ-সম্পত্তি থেকে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের বিষয়টি আটকে আছে একই কারণে। আইনের খসড়ায় ‘সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারের’ কথা আছে। বিষয়টির জোরালো বিরোধিতা করছেন প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাচেতনার লোকরা। তারা আইন সংস্কারে নারাজ। সরকারও এখন বেশ ‘সতর্ক’। দুইপক্ষের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।দুইপক্ষের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদেরকে ‘ন্যায়ের পক্ষে সমঝোতায়’ আনার চেষ্টা চলছে বলে গত সপ্তাহে তিনি গণমাধ্যমকে জানান। আইন সংস্কারের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আটকে যেতে পারে বলে আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র মত ও পথকে জানায়।

universel cardiac hospital

বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের জন্য জন্য আলাদা পারিবারিক আইন নেই। তাই বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট বৌদ্ধ পারিবারিক আইনের খসড়া তৈরি করে। অনগ্রসর চিন্তার মানুষদের বিরোধিতার কারণে আইনটি আলোর মুখ দেখেনি। আটকে আছে। আইন প্রণয়নের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যােগ নেই। হিন্দু পারিবারিক আইন দিয়ে বৌদ্ধসমাজ পরিচালিত। ফলে সম্পত্তিতে বৌদ্ধ নারীদের অধিকার নেই।

আইনে মুসলমান নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে নারী-পুরুষ সমান পাচ্ছেন না। খ্রিষ্টান নারীরা বাবার সম্পত্তিতে সমান ভাগ পান। হিন্দু নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের বেলায় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ চলে নিজস্ব প্রথাগত আইনে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকায় সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। চারটি প্রধান ধর্মাবলম্বীর পারিবারিক আইনে পার্থক্য থাকার কারণে সমাজে অবিচার রোধ করা যাচ্ছে না। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছন। অভিন্ন পারিবারিক আইনের মধ্যে অভিন্ন বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব ও প্রতিপালন, দত্তক ও পোষ্যসন্তান গ্রহণ এবং উত্তরাধিকার আইন অন্তর্ভুক্ত।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, জাতিসংঘের সিডও সনদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত ধারা প্রত্যাহার, বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনের মতো বিষয়গুলোতে হাত দেয়নি। অভিযোগ আছে, মৌলবাদীদের বিরোধিতা, তাণ্ডব বিবেচনায় সরকার এমন কৌশল নেয়।

২০১১ সালে সরকারের প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে সমানাধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়, উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে। বর্তমানে সরকারও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমানাধিকারের জায়গা থেকে সরে এসে পারিবারিক বা নিজস্ব আইনে নারী যাতে তার প্রাপ্যটুকু পায়, তা নিশ্চিত করার কথা বলছে।

২০১৩ সালে আইন কমিশন মুসলিম পারিবারিক আইনের পর্যালোচনা ও সুপারিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, প্রত্যেক ধর্মে প্রচলিত পারিবারিক আইন নারীর প্রতি কম-বেশি বৈষম্যমূলক। এতে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। এ বৈষম্য যতটা না আইনের মূল উৎসের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসের আক্ষরিক, প্রেক্ষাপটহীন ও স্বার্থবাদী ব্যাখ্যার কারণে।

হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা পুলক ঘটক আইনটি সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠনের কাজ করছেন। এ বিষয়ে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন কয়েকবার। এতে অনেকেই তাঁকে অকথ্য গালিগালাজ করেন।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘প্রচলিত পারিবারিক আইনগুলো ধর্মীয় আইন ও প্রথার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে এটা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে এবং একই সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উলে­খ রয়েছে। এরপরও আমরা কিছু অসাংবিধানিক আইন নিয়েই গত ৫১ বছর ধরে চলেছি।’

মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পদ-সম্পত্তির সমঅধিকারের কোনো বিকল্প নেই। পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান, এখানে সবার সবকিছুতে সমান অধিকার থাকতে হবে।’

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের মতে, ‘যারা হিন্দু আইনের কোনোরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজন হলে হিন্দুধর্ম এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে বক্তব্য দেন, এটি ঠিক নয়। আইন সংস্কারের কারণে ভারতের হিন্দু সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়নি।’

শেয়ার করুন