সমাজের বৈরিতা বনাম নারীর স্বাধীনতা

সাদিয়া আফরিন

নারীর স্বাধীনতা
প্রতীকী ছবি

ইতিহাসে ট্রয় নগরী ধ্বংস হওয়ার পেছনে হেলেনকেই অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। গ্রিসের ক্ষমতার লড়াই বা প্যারিসের নাম আড়ালেই থেকে যায়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী গণধর্ষণের শিকার হলেন। রাত সাড়ে ৯টার সময় তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিজের মেসে ফিরছিলেন, কতগুলো মানুষরূপী হায়েনার দ্বারা শিকার হলো পাশবিক নির্যাতনের। এটাই নাকি অনেক রাত এবং এত রাতে মেয়ে মানুষ বাইরে কেন- এই যুক্তি দিয়ে অনেকেই ধর্ষকের দোষ ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। স্বাধীন বাংলাদেশে একটা মেয়ে যদি রাত সাড়ে ৯টায় স্বাধীনভাবে চলতে না পারেন, তাহলে আর কতটা স্বাধীন আমরা প্রশ্ন থেকে যায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বীরাঙ্গনা নারীরাও কি এই সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন? না পাননি, নিজ পরিবার, সমাজ, সংস্কার তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। গল্গানি সহ্য করতে না পেরে অনেককেই বেছে নিতে হয়েছিল আত্মহননের পথ। নারীর সতীত্ব খুব দামি এই সমাজে যতক্ষণ এই সতীত্বের অজুহাতে তাদের ওপর ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘোরানো যায়। ধর্ষণের শিকার নারীকে পাপী বলেও অপবাদ দেওয়া হয়। এসব মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় দিনের পর দিন। কিন্তু ধর্ষকের পাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানুষের বড়ই অভাব।

universel cardiac hospital

পরিবার, ধর্ম, সমাজ, আইন, প্রথা, সংস্কার, সবই বলে নারী তুমি এমন, তোমার এমন থাকা উচিত, এমন আচরণ করা উচিত, এমনটা না করলে তুমি উচ্ছন্নে যাবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি আজও। মুখে মুখে যতই নারীবাদ পড়ানো হয় আর লিবারেলিজমের কথা বলা হয়, বাস্তব চিত্র দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারী জাতটা নাকি অবলা, তারা নাকি কিছু প্রকাশ করতে পারে না। আসলেই কি তাই? তারা প্রকাশ করতে পারে না নাকি প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। নারীকে তো বারবার তার ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়, সব ক্ষেত্রেই সে খারাপ।

এই সমাজে নারী ধর্ষিতা হতে পারে পোশাকের কারণে, বদ্ধ দুয়ার খুলে বাইরে যাওয়ার কারণে, শিক্ষিত হওয়ার কারণে, শ্রমজীবী হওয়ার কারণে। শিশু, যুবতী, মধ্য বয়স্ক নারী, বৃদ্ধা কেউই আজকাল বাদ যায় না ধর্ষণ নামক ভয়াল থাবা থেকে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, পথে-ঘাটে চলাকালে কেমন যেন শ্নীলতাহানির ভয় তাকে কুঁকড়ে দেয় ভেতর থেকে। সবসময় শরীর স্পর্শ করা লাগে না, এই সমাজে পুরুষের দৃষ্টিশক্তিই হাজার রকম করে নারীর শ্নীলতাহানি করে থাকে প্রতিনিয়ত।

প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামি মেনেই হোক আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের প্রথা মেনেই হোক মেয়েশিশু হলে মেরে ফেলা হতো। চিন্তা করলে গায়ে কাঁটা দেয় সবারই। মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নাজুক অবস্থা চিন্তা করেই এ রকম একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নির্দয় প্রথা মানা মনে হয় এই আধুনিক যুগে এসেও খারাপ না। আদর স্নেহ দিয়ে খাইয়ে-পরিয়ে বড় করে মা-বাবার সেই কলিজার টুকরা যদি শেয়াল-শকুনের হাতে গিয়েই পড়ে, তবে জন্মের পর মা-বাবার হাতেই শেষ হয়ে যাওয়া একেবারে খারাপ না। আদিম বর্বরতা ঝেড়ে ফেলে, সভ্যতার লেবাস গায়ে চাপিয়ে বেশ আমরা আধুনিক সমাজের নাগরিক হয়ে গর্ব করে দিব্যি বেঁচে আছি। প্রাচীন ইতিহাসের বর্বরতা পড়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবছি ভাগ্যিস সেই সমাজে জন্ম হয়নি, কী নিদারুণ নিয়মই না ছিল তখন! বর্তমান সময়ের বর্বরতা এতটা গায়ে লাগছে না, চোখে পড়েও পড়ছে না। কারণ নিজের বা আপনজনের কোনো ক্ষতি এখনও হয়নি।

প্রতিদিন পড়ছি ধর্ষণের খবর, আবালবৃদ্ধাবণিতা কেউই বাদ যাচ্ছে না নিপীড়নের হাত থেকে। ধর্ষকদের প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি যতদিন না নিশ্চিত করা হবে, ততদিন এসব নিপীড়ন চলতেই থাকবে। আমি-আপনি চুপ করেই থাকব আমাদের যতদিন আঁতে ঘা না লাগবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মেয়েদের নিরাপদে চলাচলের ক্ষেত্রে এক বড় বাধা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বারবার ধর্ষকরা পার পেয়ে যান। কোনো একটা ঘটনা ঘটামাত্র পরিবেশ, প্রতিবাদ যখন উত্তপ্ত থাকে তখন তৎপরতা দেখানো হয়, গ্রেপ্তার করা হয়, শাস্তির আশ্বাস দেওয়া হয়। আইনের ফাঁকফোকর আর ক্ষমতা দিয়ে সাজা থেকে মুক্তি ঠিকই মিলে যায়। এভাবেই চলছে, তাই একটার পর একটা ঘটনা ঘটানোর এত দুঃসাহস অপরাধীরা দেখাতে পারে।

প্রকাশ্যে যেগুলো সামনে আসে, সেগুলো নিয়েই একটু প্রতিবাদ-সমাবেশ হয়, অপ্রকাশ্যে যত কিছু ঘটছে, সেগুলোর হিসাব কি আমরা রাখি? ভোগবাদী সমাজে নারীর মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। ধর্ষিতাকেই আজও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তার পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ছিল, সে রাতে কেন বাইরে গেল। ধর্ষক কেন ধর্ষণ করল- এই গোঁড়া সমাজ একবারও প্রশ্ন তোলে না। কোথায় শাস্তির জন্য আওয়াজ তুলবে, উল্টো অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু হয়। ধর্ষণের বিচারের জন্যও মানববন্ধন, প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশ করতে হয় তাও ন্যায়বিচার মেলে না। যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনকে আবার অন্যদিকে মোড় নেওয়ার জন্য সবসময় নানা ঘটনা, অনুঘটনার জন্ম দেওয়া হয়।

কি ধনীর ফ্যাশনেবল মেয়ে, কি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মার্জিত ছাত্রী, কি খেটে খাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক, কি মাদ্রাসাপড়ুয়া পর্দানশীল মেয়ে সব ক্ষেত্রেই ভিকটিম ব্লেমিং প্রচলিত, অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হয়। এমন চলতে থাকলে, অপরাধীদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে থাকলে অপরাধ বাড়তেই থাকবে; এই সমাজ নারীর বসবাসের যোগ্য আর হয়ে উঠবে না।

সাদিয়া আফরিন: সহাকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

শেয়ার করুন