একাদশ সংসদ নির্বাচনের তিনমাস আগে গঠিত হয় বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আরো প্রায় দুই বছর বাকি থাকলেও এবার আগেভাগে নির্বাচনি জোট গঠন করে মাঠে নামতে চায় বিএনপি। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য কয়েকটি দাবি আদায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গণফোরামসহ ফ্রন্টভুক্ত অন্য দলগুলোর অবস্থান কী হবে, গত নির্বাচনের মতো জোটে থাকবে না কী না- ইত্যাদি আলোচনা আছে বিএনপির উচ্চপর্যায়ে। ঐক্যফ্রন্টের বিষয়ে রাজনীতির মাঠে প্রধান সরকারবিরোধি এ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মনোভাব, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশ, বা দলগুলোর নিজস্ব চিন্তাভাবনা কী- এসব নিয়েও দলের প্রায় সব পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
‘ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে বৃহত্তর ঐক্যের নতুন রূপরেখা’ দাঁড় করাচ্ছে বিএনপি। তাতে দলটির নেতৃত্বের বহুল আলোচিত ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের মতো পুরোনো জোটকাঠামো না-ও থাকতে পারে। দুই জোটভুক্ত দলগুলোকে নতুন ফর্মুলার ঐক্যে সঙ্গী হিসেবে চায় দলটি। নিষ্ক্রিয় ঐক্যফ্রন্টকে খালেদা জিয়া ‘কার্যকর’ দেখতে চান, তারেক রহমানের নির্দেশ ফ্রন্টকে এড়িয়ে চলার। বিএনপির বিশেষ দাবি ‘দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন’ আয়োজন। ফ্রন্টভুক্ত দলের দাবি, জাতীয় সরকার গঠন। সামনের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নতুন ঐক্য গড়ার উদ্যোগ আপাতত তাই ‘অনিশ্চয়তার’ কবলে। গোলকধাঁধায় পড়েছে ঐক্য।
নিষ্ক্রিয় ঐক্যফ্রন্ট ‘সক্রিয়’ দেখতে চান খালেদা:
বিএনপির চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শুরু থেকে ঐক্যফ্রন্ট গঠনে ইতিবাচক মনোভাব ছিল। এখন তা তিনি আরও ‘কার্যকর’ দেখতে চান। দলটির নেতাদের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর আলাপের ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরাসরি তিনি কিছু বলেননি। ‘শর্ত সাপেক্ষে’ কারাগার থেকে মুক্তির পাওয়ার পর দলের নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় তাঁরা ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপারে তাঁর ইতিবাচক মনোভাব টের পান বলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর কয়েক মাস ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ‘সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সরকারের দাবিতে’ আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় ঐক্যফ্রন্ট৷ ঘোষণার অনুষ্ঠানে ঐক্যফ্রন্টের সব দলের শীর্ষনেতা উপস্থিত থাকলেও বিএনপির কেউ যাননি। ওই দিন ‘জাতীয় সরকারের’ দাবিতে ঐক্যফ্রন্টের বিবৃতি প্রকাশের ছয়দিন পর এ বিষয়ে ‘বিস্তারিত রূপরেখা’ প্রকাশ করেন ফ্রন্টের অন্যতম নেতা, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব। এরপর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশে ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচি এড়িয়ে চলে বিএনপি।
দুই মতে দুটি পথ দুইদিকে বেঁকে যাচ্ছে?
২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। এরপর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ যোগ দেয় ফ্রন্টে। নির্বাচনের পর আবার জোট থেকে বেরিয়েও যায় কাদের সিদ্দিকীর দলটি। ফ্রন্টে দলটি আছে, কী নেই- তা অস্পষ্ট। গুঞ্জন উঠেছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে আ স ম রবের জেএসডি, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি।
বিএনপির বলয়ের বাইরে এসে জাতীয়তাবাদী ঘরানার নতুন জোটের কথা ভাবছে দলগুলো। ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দল নতুন জোট গঠন হলে যোগ দিতে পারে। জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যকে যুক্ত করার আলোচনা চলছে। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রাজি হলে তাঁকে জোটের নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা আছে।
গত সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্যে আবদুর রব, অলি আহমদ, মুহাম্মদ ইবরাহিম ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’ আয়োজনের দাবি জানান। এ দাবিতে বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে তাঁরা আন্দোলন করেন। এখন তাঁদের বক্তব্য ভিন্ন। বিএনপির সঙ্গে তাঁদের মতের অমিল। তাঁরা বলছেন, জাতীয় সরকার গঠনের কথা। তাঁদের নেতৃত্বে সম্ভাব্য জোটের বিশেষ দাবি হবে জাতীয় সরকার গঠনের। নাগরিক ঐক্য ‘জাতীয় সরকারের’ কথা না বললেও ‘দীর্ঘ মেয়াদের নির্বাচনকালীন সরকারের’ দাবি জানাচ্ছে।
বিএনপির দাবি, রব-অলির জোট গঠনের পরিকল্পনা ও নিজ দলের কয়েক নেতার এর সঙ্গে গোপনে সম্পৃক্ততার পেছনে দূর থেকে সরকারসংশ্লিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর ‘সমর্থন’ ও ‘ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে। বিএনপিকে চাপে রাখতে জামায়াতও এ কৌশল করাতে পারে। তবে ড. কামালের এখনো অবস্থান ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার’ গঠনের পক্ষে।
যোগাযোগ করলে গণফোরামের সভাপতি মত ও পথকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন ওই অর্থে ঐক্যফ্রন্ট কার্যকর নেই। এটা পুনরুজ্জীবিত করা বা নতুন করে একটি ঐক্য করার সম্ভাবনা সব সবসময় আছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর দাবি আমরা জানাচ্ছি। দলীয় সরকারের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না, তা নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই, তাহলে কীভাবে এমন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠঠান হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আইনজ্ঞ ড. কামাল বলেন, ‘দাবি তুললে আলোচনার মাধ্যমে এগুলো আদায় করা যায়। জনগণের কাছ থেকে দাবি উঠলে এটা হতে পারে। এ বিষয়ে আন্দোলন বা কর্মপন্থা ঠিক করতে পরবর্তী সময়ে দলীয় ফোরামের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’