বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ও ডিবি প্রথম, দ্বিতীয় র‌্যাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্দুক যুদ্ধ
ফাইল ছবি

২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৫৯১ জন। ছয় ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এসব ঘটনা সর্বাধিক ঘটিয়েছে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে র‌্যাব। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশের গুলিতেও নিহত হয়েছেন মানুষ। ৮টি জেলা বাদে গোটা বাংলাদেশেই সরকারি ভাষ্যমতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে।

শনিবার (১২ মার্চ) সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘নির্বিচার প্রাণনাশ? বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে এক ওয়েবিনারে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে ওয়েবিনারে জানানো হয়।

universel cardiac hospital

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সিজিএসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সিজিএসের কয়েকজন গবেষক গবেষণায় অংশ নেন। আইনবহির্ভূত এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনুশীলনের গুরুতর পরিণতি বোঝার জন্য এই গবেষণাটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য ওয়েবিনারে প্রকাশ করেন আলী রীয়াজ।

তিনি জানান, ২০১৯-২০২১ পর্যন্ত তিন বছরের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা করা হলেও এতে স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঘটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর্যালোচনা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বন্দুকযুদ্ধের ক্ষেত্রে পুলিশ এবং ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্টতা আছে ২৩৫টি ঘটনায় এবং র‍্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে ১৫৬টি ঘটনায়।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আদালতের সঠিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ৫১২, ক্রসফায়ার ৪, গোলাগুলি ১৫, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ১৫, গুলি করে হত্যা ৩৪ এবং নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। গুলি ছোড়া হলে প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছে বোঝাতে বন্দুকযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ৮৬ শতাংশ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর ১৭টি ঘটনা ঘটলেও গুলি করে হত্যা, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০০৫, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ে। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এই সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

২০১৮ সালের ১৫ মে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়।

এই সময়কালে কোনো কোনো জেলায় দিনে একজনের বেশি মানুষও নিহত হন। গবেষকেরা সময় বেঁধে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচারের সুপারিশ করেছেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৫৯ জন মারা যান। হৃদ্‌রোগে তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল বলে সে সময় যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়েছিল সে সময়কার সংসদ। কিন্তু পরে দায়মুক্তি বহাল থাকেনি।

শাহদীন মালিক আরও বলেন, দায়মুক্তির দুনিয়া বদলে গেছে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, কারাগারে চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার হবে কেউ কখনো ভাবেনি। কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় সত্তরের দশক কিংবা এরপর ঘটে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনার বিচার হবে না এমন আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এসব ঘটনার বিচার হয়েছে। এ দেশে বন্দুকযুদ্ধেরও বিচার করা সম্ভব।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান সুশাসন নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা, জবাবদিহি নিশ্চিতের কথা বলেন। কথায় কথায় ‘গুম করে দাও’, ‘ক্রসফায়ার দাও’, ‘এনকাউন্টার করা উচিত’ ইত্যাদি বাক্য ব্যবহারেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে যেন শান্তিরক্ষী মিশনকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়, সেদিকে নজর রাখার অনুরোধও তিনি করেন।

ওয়েবিনারে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খান বলেন, আইনের প্রতি অনাস্থা থেকে মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করছে। আদালত, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করা না গেলে এ অবস্থার উন্নতি হবে না। তিনি আরও বলেন, শুধু ভোটের সময় নয়, উৎসব-অনুষ্ঠানের আগেও বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামের বিদেশফেরত দুই ভাইকে গুলি করে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করেন তিনি। চাঁদা না দেওয়ায় এ দুই ভাইকে চট্টগ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে তাঁদের লাশ টেকনাফ থেকে উদ্ধার করা হয়।

সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সবাই যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন বিষয়টি এমন নয়। ট্রাকের সামনে ফেলে দেওয়ার ঘটনা আছে। এসব ঘটনার কোনো তদন্ত হয় না। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম যে হাজার দেড়েক মানুষ প্রতিবছর বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে, তাঁরা কারা জানা যায় না। তিনি বলেন, জীবনের অধিকার, মানবাধিকার, কথা বলার অধিকার না থাকলে কোনো উন্নয়নই উন্নয়ন নয়।

ওয়েবিনার সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এই গবেষণাটি সরকারকে পাঠানো হবে এবং এটি নিয়ে আরও আলোচনা হবে।

শেয়ার করুন