খুলনায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজন আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গড়ে আরো বেশি জন। স্বজনরা সময়মতো চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় অনেকের জীবন রক্ষা হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে এ জেলায় আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, সে হারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সচেতনতা বাড়ছে না।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহ জেলায় আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এরপরের অবস্থানে আছে জয়পুরহাট। এ দুটি জেলায় আত্মহত্যায় মৃত্যু ও আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনা গত কয়েক বছর ধরে তুলনামুলক বেশি ঘটছে। মত ও পথের অনুসন্ধান বলছে, আত্মহত্যায় মৃত্যু ও আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনার সংখ্যাগত দিক থেকে খুলনার যে অবস্থান, তা সেভাবে আলোচনায় আসছে না। গত তিন বছর ধরে এ জেলায় আত্মহননের মতো নির্মম ঘটনা ক্রমে বাড়ছে।
কীটনাশক পানে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে, চলন্ত যানবাহনের নিচে ঝাপ দিয়ে, বা অন্যভাবে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টাকালে স্বজন, প্রতিবেশিদের চোখে পড়লে তারা তাকে উদ্ধার করে আশপাশের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান। বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণত এ ধরনের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় না। ফলে বেশিরভাগ রোগীকে নেওয়া সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে।
সরকারি হাসপাতালে প্রতি মাসে কতোজন কোন রোগে চিকিৎসা পায়, কতোজন ভর্তি হন, কতোজন মারা মান, কতোজনের অপমৃত্যু হয়- ইত্যাদি লেখা থাকে। মাস শেষে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালের এসব তথ্য ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এমআইএস) কাছে পাঠানো হয়। এ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে খুলনায় আত্মহত্যার ঘটনার চিত্র উঠে আসে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার মুঠোফোনে মত ও পথকে বলেন, ‘করোনার আগে এ হাসপাতালের তথ্যে আত্মহত্যার হার ছিল ৪৫ শতাংশ। এ বছর তা এসে দাঁড়ায় ৬৬ শতাংশে। মানসিক দুশ্চিন্তা ,পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি আত্মহত্যার মূল কারণ। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি।’
করোনাকালে আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের সংখ্যা শুধু ওই তিন জেলায় নয়, দেশের সব এলাকায় বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর বড় কারণ দারিদ্র, বেকারত্ব। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ হতাশ হলে ঠুনকো কারণে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। তখন তিনি নিজেকে একা মনে করেন। আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আপাতদৃষ্টিতে, অন্যদের কাছে মৃত্যুর কারণ ছোট মনে হলেও ওই কারণ ওই মুহূর্তে ওই ব্যক্তির জন্য অনেক বড় কারণ হয়ে সামনে আসে।
এমআইএস বিভাগের কাছে হাসপাতালে অপমৃত্যুর তথ্য পাঠিয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এতে দেখা যায়, অপমৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ আত্মহত্যা। ২০১৯ সালে ওই জেলায় ৩০০টি, ২০২০ সালে ২৮০টি, ২০২১ সালে ৩৮৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৫টি আর ফেব্রুয়ারিতে আত্মহত্যার ঘটনা ৩৪টি।
ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার মনে করেন, ‘ঝিনাইদহ, খুলনায় আত্মহত্যার হার কেন বেশি, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। এর পেছনে ভৌগলিক, জলবায়ুগত, জেনেটিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কারণের মধ্যে কোনটি বেশি কাজ করেছে- তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দরকার। সাধারণত আত্মহননের পেছনে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কারো জিনের মধ্যে হতাশা, মানসিক অস্থিরতার বিষয়টি থাকতে পারে। আবার একজন মানুষের বেড়ে ওঠার সময় তার পরিবার, চারপাশে আত্মহত্যার উদাহরণ থাকা- এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে দেশের আত্মহত্যার চিত্র উঠে এসেছে। করোনাকালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট—এসব আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি। পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২২টি আত্মহত্যার ঘটনাকে বেছে নেয় সংগঠনটি।