নারীর বড় শত্রু ধর্মীয় মৌলবাদ, অর্থনৈতিক দারিদ্র, না শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা- প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হয়নি। তবে সমাজে পরিবর্তন এসেছে। রক্ষণশীলতা কমেছে, পুরুষের সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। শিক্ষায় নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসছে। পরিবর্তিত সামাজিক চেহারায়ও সাংবাদিকতা পেশায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পুরুষের ‘আধিপত্য’। সমতা নেই। ঢাকার বাইরের চিত্র আরো করুণ। টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন সংবাদ পোর্টাল, বেতার মিলিয়ে কর্মরত নারীর সংখ্যা একেবারেই হাতেগোণা। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিনিধি, বা সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা করছেন মাত্র কয়েকজন।
ঢাকার বাইরে মোট কতো নারী সাংবাদিক আছেন, এ বিষয়ে কোনো সংগঠনের কাছে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে অন্তত এক হাজার নারী সাংবাদিক আছেন। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, চাকরিচ্যুতি, যৌন হয়রানিসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন রাজধানীর বাইরের নারী সাংবাদিকরাও। পারিবারিক পর্যায়ে উদারতার অভাব, সামাজিক রক্ষণশীলতা, যথাযথ কর্মপরিবেশ না থাকায় অনেক তরুণী ঢাকার বাইরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহ বোধ করেন না।
গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আসছেন তারা। তৃণমূলে তাদের সংখ্যাটা আগের তুলনায় বেড়েছে। যদিও তা হতাশাজনক। বাংলাদেশসহ ১৪৪টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ‘গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্ট ২০১৫’ শিরোনামের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ৮৪ শতাংশ পুরুষ, ১৬ শতাংশ নারী। যা পুরুষ সহকর্মীদেরকে লজ্জিত করলেও অস্বীকারের উপায় নেই।
এসব প্রসঙ্গে কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘রাজধানীর মূলধারার সাংবাদিকতায় নারীর সংখ্যা কম। ঢাকার বাইরে তা বেশি হবে কীভাবে! প্রথাগতভাবে মফস্বল সাংবাদিকদের পরিচিতি- প্রতিনিধি। ঢাকার সাংবাদিকদেরকে বলা হয় নিজস্ব প্রতিবেদক। এর বাইরের সাংবাদিকরা নিজস্ব নন। পরিচিতিমূলক শব্দগুলোতে এক ধরনের বৈষম্য, অস্বীকৃতির মনোভাব। এটাকে ঢাকার বাইরে নারী সাংবাদিক কম হওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে সাংবাদিকতায় নারীরা আসতে উৎসাহ দেওয়া হয় না। বাধা দেওয়া হয়। সেখানে কাজ করার পরিবেশ নারীর জন্য কতোটা অনুকূল, তা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। প্রতিবেদন লিখতে হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষুর সামনে। নারীর সাংবাদিক হওয়ার নিরাপত্তার বিষয়টিও মূখ্য। সাহস করে কেউ কেউ এগিয়ে আসতে চাইলে রাজধানীর সংবাদ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র সেটিকে গ্রহণ করে ওঠতে পারে না। এসবের সঙ্গে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ও আছে।’
এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক নাদিরা কিরণ মত ও পথকে রোববার বলেন, ‘ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ এখনো গড়ে ওঠেনি। কর্মস্থলে সহকর্মীরা তেমন সহযোগী মানসিকতার হন না। অন্যান্য সাংবাদিকরাও কাজে সহায়ক মনোভাব পোষণ করেন না। নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কায় পরিবারও আগ্রহী হয় না। রাতে সংবাদ সংগ্রহে যাতায়াত সমস্যা রয়েছে। দূরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্যে মোটরসাইকেলে নারী সাংবাদিকের চলাচল স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজ অভ্যস্ত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের দিন-রাতের যে কোনো সময় সংবাদ সংগ্রহে ছুটতে হয়। এটা নারীদের বেলায় মানতে চান না স্থানীয়রা। এসব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা আগ্রহী হন কম। স্থানীয় গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদকও তাদের কর্মসুযোগ তৈরি করে দিতে তেমন আগ্রহী হন না।’
সাংবাদিক, গীতিকার তাপস রায়হান মনে করেন, ‘পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মিশেলে জন্ম নেয় ব্যক্তির অন্তর্গত বোধ। ঠিক সেখান থেকে জন্ম নেয় আত্মমর্যাদা। ঢাকার বাইরে নারী সাংবাদিকের ক্ষেত্রে নিজেকে গড়ে তোলার সেই সুযোগ কম। যা পরিবার ও সমাজের সীমাবদ্ধতা। সাংবাদিকতা ধীশক্তি সম্পন্ন আত্মমর্যাদাশীল পেশা। নারীর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মূখ্য।’
দৈনিক সংবাদ সারাবেলার বিশেষ প্রতিনিধি শাহনাজ পারভীন এলিস বলেন, ‘পারিবারিক, সামাজিক বাধা প্রবল। এর কারণে ঢাকার বাইরের জেলা, থানা শহরগুলোতে এখনো নারীরা সাংবাদিকতায় আসতে উৎসাহিত হন না। পরিবার, আপনজনদের উৎসাহ না থাকায় অনেকে এ পেশায় জড়াতে আগ্রহ বোধ করেন না। আমার দাদার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায় একজন নারীও সাংবাদিকতায় নেই। কেন নেই- প্রশ্নে জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ জানান, দুই-একজন নারী সাংবাদিকতায় ছিলেন এর আগে। এখন নেই। নারীদের সাংবাদিকতায় পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা লাগে। এসব নিয়ে অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়।’
বাসসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ সিদ্দীকি সোমা বলেন, ‘সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেইl চ্যালেঞ্জকে সাদরে, সহজে নেওয়ার সাহস নিয়ে নারীরা এগিয়ে এলেও নানা বাঁধার মুখে তাদেরকে পিছিয়ে পড়তে হয়l এ চিত্র রাজধানীর বাইরে আরো প্রকট। চাকরির অনিশ্চয়তা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশের অভাব, মাতৃত্বকালীন ছুটি না থাকা, পারিবারিক চাপ, যৌন হয়রানির শিকার ইত্যাদি তো আছেই। বেতন ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন তারা।’
তিনি যোগ করেন, ‘পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা এখনো সেভাবে প্রতিঠানিক রূপ পায়নি। ঢাকার বাইরে চাকরি টিকিয়ে রাখতে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা বড় অবলম্বনl বিজ্ঞাপন সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ সব নারীর পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আগ্রহ, উদ্যেম নিয়ে তারা সাংবাদিকতায় এলেও রাশি রাশি হতাশা নিয়ে পেশার মায়া ছাড়তে হয়।’
সারাবাংলাডটনেটের বিশেষ প্রতিনিধি ঝর্ণা রায়ের কথাগুলো নিজের নিরেট অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তাঁর ভাবনাগুলো এ রকম- ‘সাংবাদিকতায় আমার শুরুটা মফস্বল শহর থেকে। মফস্বলে প্রথমত বাঁধা আসে পরিবার থেকে। সমাজ এখনো মেয়েদের সাংবাদিকতার মতো পেশায় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। মেয়েরা যে ছেলেদের মতো মফস্বলেও সাহস নিয়ে কাজ করতে পারেন, সেই চিন্তাই অনেক গণমাধ্যম মালিকের মাথায় নেই। তাদের ধারণা, মেয়েরা পারবেন না। যারা সমচিন্তা করেন, তারা মফস্বলে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে যে পরিমাণে সম্মানি দেন, তাতে পরিবার নিয়ে চলা তো দূরের কথা, নিজের খরচ চালানোই কঠিন।’
তিনি যোগ করেন, ‘এসব কারণে মেয়েদের প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মফস্বলে কাজ করতে পারেন না। মফস্বল সাংবাদিকতায় তাদেরকে নিশ্চিত করতে, সমতা আনতে তাদেরকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে হবে। আয় বাড়লে পরিবারও তার এ কাজে সায় দেবে।’