প্যারাসিটামল গ্রুপের বিষাক্ত সিরাপ সেবনে ১৯৯২ সালে দেশে ৭৬ শিশুর মৃত্যু হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তা সেবন করে অন্তত পাঁচশত শিশু মারা যায়। কতো শিশুর কিডনি তখন অকেজো হয়েছিল, তা আজও অজানা। ২০০৯ সালে এ সিরাপ পান করে সারাদেশে ২৮ শিশু মারা যায়। ভেজাল ওষুধ সেবনে শিশুমৃত্যুর ঘটনা যেন প্রতি দশকে একবার দেশের বিবেককে একসঙ্গে নাড়া দেয়। যদিও মানহীন ওষুধ সেবনে শিশুমৃত্যুর ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটে।
সংখ্যায় কম বলে সেসব নির্মম ঘটনা সেভাবে আলোচনায় আসে না। বাজারে ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ির অভিযোগ বরাবরই আছে। মানসম্মত নয়, এমন কয়েকশত প্রতিষ্ঠান ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাত করছে। সবশেষ গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ‘ভেজাল নাপা সিরাপ’ পান করে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। গত প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে শুধু ভেজাল প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনে কতো শিশু মারা গেছে, এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।
দশকের পর দশক ধরে এভাবে চলতে থাকলেও বেশিরভাগ মামলায় আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে না রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের তদন্তে গাফিলতি থাকে। আসামিরা খালাস পেয়ে যান। তদন্তে দুর্বলতার কারণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের পার পেয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত বেশ আছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তার যোগসাজশে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যান। এতে বিচার থেকে বঞ্চিত হন ভুক্তভোগীরা। বিদ্যমান আইনে সুযোগ না থাকায় তারা প্রতিকার চাইতে পারেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই শিশুর মৃত্যু প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ আজ সোমবার বলেন, ‘আশুগঞ্জের যে দোকান থেকে কেনা ওষুধ সেবনের পর শিশু দুটি মারা গেছে, সেই দোকান থেকে আটটি বোতল জব্দ করেন তারা। পাশাপাশি দুটি ব্যাচের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষায় তিনটি ব্যাচের নাপা সিরাপে ক্ষতিকর কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। যে বোতলের সিরাপ শিশু দুটিকে খাওয়ানো হয়েছিল, সেটা এখনো পরীক্ষা করতে পারেনি অধিদপ্তর।’
অনুসন্ধান বলছে, রিড ফার্মার তৈরি করা প্যারাসিটামলের সিরাপে বিষাক্ত উপাদান থাকায় তা পান করে ২০০৯ সালে সারাদেশে ২৮ শিশু মারা যায়। ওই বছরের ১০ আগস্ট ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক তত্ত্বাবধায়ক আদালতে মামলা করেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে এর রায় হয়। মালিকসহ পাঁচজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। রায়ে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তদন্তে গাফিলতি ছিল। তাই আসামিদেরকে খালাস দেওয়া হলো। মামলার আলামত আইনসম্মতভাবে জব্দ করা হয়নি। জব্দের স্থানও সঠিক নয়।’
জানা যায়, জব্দ করার নিয়ম হলো- মামলার আলামত চার ভাগে বিভক্ত করতে হয়। জব্দ করা আলামতের একটা অংশ দিতে হয় আসামিপক্ষকে, আরেকটি অংশ পাঠাতে হয় আদালতে। আলামত নিজের দখলেও রাখে ঔষধ অধিদপ্তর। আরেকটা নমুনা পাঠাতে হয় ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে। রিড ফার্মার বিরুদ্ধে করা মামলার আলামত জব্দে প্রচলিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। আদালতে কোনো নমুনা পাঠানো হয়নি।
নব্বইয়ের দশকে বাজারে ছিল ‘ফ্ল্যামোডল’ নামে প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। এ সিরাপ সেবনে ৭৬ শিশুর মৃত্যু হয়৷ নির্মম এ ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। ওষুধটির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেমের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলার রায় হয় ২০১৪ সালে৷ এতে তিনজনকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়৷ ১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ আটজনকে আসামি করে মামলাটি করা হয়।
১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে কিডনি বিকল হয়ে শিশুমৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওই হাসপাতালের তখনকার পরিচালক বিগ্রেডিয়ার (অব.) মকবুল হোসেন ১৯৯১ সালের ৩ জুলাই ঔষধ প্রশাসনকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করেন। ওই সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়।
১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ভেজাল ওষুধ সেবনে কিডনি অকেজো হয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। তখনকার আইপিজিএমআর হাসপাতালের এক চিকিৎসক ১৯৮৬ সালে ছয় শতাধিক শিশুর কিডনি ডায়ালাইসিস করেন। এসব শিশুর বেশিরভাগই মারা যায়। এ ছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালেও প্রায় পাঁচশত শিশুর মৃত্যু হয়। ভেজাল ওষুধ সেবনের ফলে এদের কিডনি বিকল হয়ে যায়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঔষধ অধিদপ্তর আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ঝিগাতলার প্রতিষ্ঠান বিসিআই উৎপাদিত প্যারাসিটামলে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ মেলে। এর ভিত্তিতে ১৯৯২ সালের ১৮ নভেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক আবুল খায়ের একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট এর রায়ে বিসিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ ছয়জনকে দশ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে দুইলাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
উল্লেখ্য, প্যারাসিটামল গ্রুপ দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধগুলোর একটি। এ জেনেরিকের ওষুধগুলোর মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালসের উৎপাদিত নাপা সিরাপ ও বড়ি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। নাপাকে বলা হয়, ‘ব্র্যান্ড লিডার’! দেশের যে কোনো ফার্মেসি থেকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া প্যারাসিটামল ওষুধ কেনা যায়।