এবারে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকে মো. আমির হামজাকে নির্বাচিত করতে নীতিমালা অনুযায়ী প্রথমে বাণিজ্যসচিব তাঁর নাম প্রস্তাব করেন। এতে মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী এক সদস্যের সমর্থন ছিল। আমির হামজার লেখার সাহিত্যমূল্যের চেয়ে আমলাতন্ত্র পুরস্কার নিশ্চিতে বেশি কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, বাণিজ্যসচিব তাঁর লেখা পড়েননি। ‘মরণোত্তর পুরস্কার’ পাওয়া আমির হামজার ছেলের মুখে তাঁর লেখা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। তাঁর ছেলেও উপসচিব।
স্বাধীনতা, একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা কারা পাবেন, যে কমিটি তা নির্বাচন করে, সেই মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। গত কয়েকবারের মতো এবারও বিতর্ক ওঠেছে। দেশের বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা চলছে।
অতীতে দেখা গেছে, পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় এমন ব্যক্তির নাম ছিল, যাঁদের ঠিক কী কারণে, কী অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হচ্ছে, তা অনেকে বুঝতে পারেন না। বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে ওঠে প্রতিবাদ। সামরিক শাসনামলে বিতর্কিত, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীর নামও যুক্ত হয় পুরস্কারের তালিকায়।
রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচনকালে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ অবদান রেখেছেন, এমন সীমিতসংখ্যক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা করার কথা নীতিমালায় থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পায় বলে অভিযোগ আছে।
এসব বিতর্কের কারণে পুরস্কার পেয়েও দেশের বিশিষ্টজনদের মধ্যে কেউ কেউ তা বলতে রীতিমতো ‘অস্বস্তি’ বোধ করেন। ‘অস্বস্তি’ এড়াতে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘটনাও আছে। ২০১৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও তা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি, প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একুশে পদক পেয়েছেন। কিন্তু এটি বলতে তিনি ‘অস্বস্তি’ বোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘পুরস্কারের জন্য যে কমিটি কাজ করে, সাহিত্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সঙ্গীত, নৃত্য, চারুকলার মতো বিষয় তারা কতটা বোঝে? এসব ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির অবদান বিচার করার কী যোগ্যতা তারা রাখে? আমলা হোক, মন্ত্রী হোক- সবার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, যার যে যোগ্যতা নেই, তাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়। যিনি বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের জন্য স্বীকৃত হবেন, তাদের নির্বাচন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন এমন কাউকেই করতে হবে।’
২০২০ সালে স্বাধীনতা পদক নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা হয়। ওই বছর একুশে পদকও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি। বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে ওঠে প্রতিবাদ। এতে শামিল হন এর আগে একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তরাও। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও ছিলেন তালিকায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ড. নূহ-উল আলম লেনিন ওই বছর স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীতদের মধ্যে দুজনকে কেন পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে, এর জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ব্যাখ্যা দিতে বলেন।
২০২০ সালে যে দুজনকে নিয়ে সমালোচনা হয়, তাঁদের একজন সাহিত্যে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ, সংস্কৃতিতে কালীপদ দাস। রইজ উদ্দিন আহম্মদের পরিচয়ের সঙ্গে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে। তিনি আসলে মুক্তিযোদ্ধা কী না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিতর্কের জেরে তাঁর নাম পরে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
২০১৬ সালের স্বাধীনতা পদক ঘোষণার ১৩ দিন পর যুক্ত হয় কবি নির্মলেন্দু গুণের নাম। ওই বছর মূল তালিকায় নাম না থাকায় তিনি ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করে ১২ মার্চ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস লেখেন। এরপর পূর্বঘোষিত তালিকায় তাঁর নাম যুক্ত করার ঘোষণা আসে।