রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকেই পুরস্কার দেওয়া হয় যারা দেশের নানাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হন। বলা যায়, তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। আর স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার। সাধারণত জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এই পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হওয়া মানে কোনো অশনি সংকেত। এমনটি বলার কারণ হচ্ছে, একটা দেশে যখন মহীরুহগণ উপেক্ষিত হতে থাকেন, গৌণরা গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি পেতে থাকেন এবং দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভালো-মন্দ যখন আমলারা ঠিক করে দেন, তখন এটাকে অশনি সংকেত হিসেবে ধরে নেওয়াই যায়।
সাহিত্যে ‘বিশেষ অবদানে’র জন্য এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন মো. আমির হামজা। কিন্তু, অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, আমির হামজা কে? দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িতদের কেউ আমির হামজার নাম জানেন না, আগে কখনো তার নাম শোনেননি! তাহলে তিনি কে? এবার চমকে যাওয়ার পালা! তার অনেক গুণ-পরিচয়ের পাশাপাশি এমনটিও জানা যায় যে, মো. আমির হামজা খুনের মামলায় আসামি ছিলেন। মাগুরার শ্রীপুরের বরিশাট গ্রামে ১৯৭৮ সালে খুনের ওই ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় মো. আমির হামজাসহ ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। নিহত ব্যক্তির স্বজন ও দণ্ডিত অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। তবে খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে মো. আমির হামজার বড় ছেলে মো. আলী মর্তুজা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তিনি মামলার আসামি হয়েছিলেন এবং কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। তবে খালাস পেয়ে যান। মিথ্যা অভিযোগে মামলা হয়েছিল। গ্রামে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা প্রায়ই ঘটে।’
একইসঙ্গে আরও জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন পালাকার, গীতিকার। মুখে মুখে গান রচনা করতেন ও সেসব গান নানা আসরে পরিবেশন করতেন। রাজনীতি, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে গান লিখেছেন। তার গানের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তিনি কি সাহিত্য ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য? আমি মনে করি না যোগ্য। কারণ সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুটি আলাদা বিষয়। গান যতটা না সাহিত্য, তার চেয়ে বেশি সংস্কৃতিভুক্ত। আর এমন বাস্তবতায় খুব বেশি যৌক্তিক মনে হলে তাকে সংস্কৃতিতে কিংবা সংগীতে অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা যেত। তাছাড়া সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার মতো তার চেয়ে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন আরও অনেকে আমাদের দেশে ছিলেন নিশ্চয়ই? সাহিত্য-সংস্কৃতির মহীরূহদের বাদ দিয়ে, দিনের পর দিন উপেক্ষা করে রইজ উদ্দিন (পরে বাতিল) কিংবা মো. আমির হামজাকে যখন একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, তখন বিতর্ক সৃষ্টি হতেই পারে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালে এই স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া শুরুর পর চতুর্থ বছরে, ১৯৮০ সালেই তা বিতর্কের ঝড় তোলে। সে বছর শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয় মওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে। যিনি শর্ষিনার পীর হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে সুপরিচিত। তারপর ২০২০ সালে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ নামের এক ব্যক্তিকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করা হয়। সাহিত্য অঙ্গনে একেবারে অপরিচিত ওই ব্যক্তির পুরস্কার অবশ্য পরে দেওয়া হয়নি। সেবার রইজ উদ্দিনের নাম এসেছিল ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। এ বছরও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ঘোষণার পরপরই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সাহিত্য ও বোদ্ধামহলের পাশাপাশি সাধারণের মধ্যেও তির্যক সমালোচনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে- এই পুরস্কারগুলোর জন্য মনোনয়ন দেয় কারা? কারণ স্বাধীনতা, একুশে পদক খুবই সম্মানিত পদক৷ অনেক নিরলস সাহিত্যকর্মী সারাজীবন সাহিত্যচর্চা করেও এসবের ধারে কাছে যেতে পারে না৷ কারণ তারা লবিং ও তদবির করতে পারে না!
মনে প্রশ্ন জাগে- আমাদের দেশে পুরস্কার প্রদানের নামে হচ্ছেটা কী? পুরস্কারগুলো কোন বিবেচনায় দেওয়া হচ্ছে? পুরস্কার দেওয়ার কাঠামোটি কি সর্বজনস্বীকৃত? যদি তা গ্রহণযোগ্য একটি কাঠামো থেকেই দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক কিংবা বাংলা একাডেমির মতো পুরস্কার ঘোষণার পর বিতর্ক দেখা দিচ্ছে কেন? এসব নিয়ে গুরুতর যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো দেখার দায়িত্ব কার? কারা তবে এক্ষেত্রে অপরাধী? এবার তবে বলতে হয়, গর্হিত অপরাধটি আসলে তারাই করেছেন, যারা এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজকর্মেই বেশি উৎসাহী আমলা- এমন মানুষজন যদি পুরস্কারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন, তা হলে কোনোদিনই কি সঠিক ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া সম্ভব? আরও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশে কেবল সাহিত্য পুরস্কার নয়-শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, বিচার বিভাগ, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রতিনিয়ত বিতর্ক হচ্ছে। কেননা এসব সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকভাবে। বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করবেন, সুনির্দিষ্ট কাঠামোর প্রতিনিধিরা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং আমলাতন্ত্র তা বাস্তবায়ন করবে-এই ভারসাম্যমূলক প্রক্রিয়া যদি অনুসরণ করা না হয়, তা হলে পুরস্কার দেওয়া বিষয়টি ভবিষ্যতেও ব্যক্তির ইচ্ছা ও দলবাজির শিকার হবে। আর এমনটি হলে বিতর্কের ঝড় যে থামবে না। যা কারো কাম্য নয়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক