প্রেমিককে বিয়ে করতে বিষ মিশ্রিত মিষ্টি খাইয়ে দুই শিশুসন্তান ইয়াছিন খান (৭) এবং মোরসালিন খানকে (৫) হত্যা করে মা রিমা আক্তার। ওই মিষ্টি এনে দিয়েছিল রিমার প্রেমিক সফিউল্লাহ ওরফে সোফাই মিয়া।
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) বিকালে প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগে দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বেগম আরেফিন আহম্মেদ হ্যাপির আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে সন্তানদের হত্যার কথা স্বীকার করে রিমা। বিকালে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, আশুগঞ্জের দুর্গাপুর এলাকার নজরপাড়ার বাসিন্দারা এ ঘটনায় জড়িত রিমা এবং তার প্রেমিক সফিউল্লাহর ফাঁসি চেয়েছেন। নজরপাড়ার বাসিন্দা শিউলি আক্তার বলেন, মা হয়ে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে, আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। এ ঘটনায় জড়িত রিমা ও সফিউল্লাহর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা।
একই পাড়ার বাসিন্দা নেহার বেগম বলেন, ঘটনার পর থেকে রিমার গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক। পুলিশ ও সাংবাদিকরা এলে কান্নার ভান করতো। পরে স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করেছিল। এখন নিশ্চিত হলাম, রিমা ও তার প্রেমিক এই ঘট্না ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে এই এলাকার মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। তাদের কারণে এলাকায় নাপা ওষুধ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা তাদের ফাঁসি চাই।
প্রতিবেশী হান্নান মিয়া বলেন, এ ঘটনার বিচার না হলে এরকম ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। আমরা চাই, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
নিহত দুই শিশুর বাবা ইটভাটাশ্রমিক ইসমাইল হোসেন সুজন বলেন, দুদিন আগে রিমার কাছে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও সিমটি চেয়েছিলাম। রিমা প্রথমে জানায় মোবাইল ও সিম ভেঙে ফেলেছে। মোবাইল না দিলে আমি আত্মহত্যার হুমকি দিই। পরে জানায় মোবাইলসহ সিমটি সফিউল্লাহ সোফাই মিয়ার কাছে। সোফাই মিয়ার কাছে কেন জানতে চাইলে ঝগড়া লেগে যায়। একপর্যায়ে জানায়, তার সঙ্গে সোফাই মিয়ার প্রেমের সম্পর্ক আছে। তাকে বিয়ে করবে। পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য সোফাই মিয়ার পরামর্শে মিষ্টির সঙ্গে বিষ খাইয়ে আমার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে। বুধবার দুপুরে হত্যার কথা আমার কাছে স্বীকার করে রিমা। রাতে তাকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের কাছেও হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুজন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িত রিমা এবং তার প্রেমিক সোফাই মিয়ার ফাঁসি চাই। দুই সন্তান হত্যার বিচার না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো।’
আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ রহমান বলেন, ১২ বছর আগে ইসমাইল হোসেন সুজন এবং রিমার বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে তাদের তিন সন্তানের জন্ম হয়। বড় ছেলে জন্মের দুদিন পর মারা যায়। পরবর্তী সময়ে তাদের আরও দুই সন্তান হয়। মেজো ছেলে মোহাম্মদ ইয়াছিন খান এবং ছোট ছেলে মোরসালিনকে নিয়ে চলছিল তাদের সংসার। অভাব-অনটনের কারণে রিমা আশুগঞ্জ উপজেলার এসআলম অটোরাইস মিলে কাজ নেয়। অপরদিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার একটি ইটভাটায় শ্রমিকদের টিকিট বিলির কাজ নেয় সুজন। অভাব-অনটন ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছিল। এরই মধ্যে রিমা এসআলম অটোরাইস মিলের শ্রমিক সর্দার সফিউল্লাহ সোফাই মিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। গত সাত মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। এরই মধ্যে রিমাকে বিয়ের আশ্বাস দেয় সফিউল্লাহ। তবে শর্ত জুড়ে দেয়, দুই সন্তানকে ছাড়া বিয়ে করবে। এ অবস্থায় গত ১০ মার্চ বিকাল ৫টার দিকে সফিউল্লাহ বিষ মিশ্রিত পাঁচটি মিষ্টি রিমার কাছে পৌঁছে দেয়।
ওসি বলেন, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই দিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে দুই শিশুর জ্বর এসেছে বলে দুর্গাপুর বাজারের ‘মা ফার্মেসিতে’ শাশুড়িকে ওষুধ আনতে পাঠায়। শাশুড়ি ‘মা ফার্মেসিতে’ যাওয়ার সুযোগে রিমা দুই ছেলেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিষ মিশ্রিত মিষ্টি খাওয়ায়। এর মধ্যে তিনটি মিষ্টি বড় ছেলে ইয়াছিনকে খাওয়ায় এবং ছোট ছেলে মোরসালিনকে দুটি মিষ্টি খাওয়ায়। শাশুড়ি বাড়ি আসার পর শিশুদের আধা চামচ করে নাপা সিরাপ খাওয়ায় মা। এরপর শিশুরা বমি করতে থাকে। তাদের আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে সন্তানদের চিকিৎসা না করিয়ে বাড়ি নিয়ে যায় রিমা। পথিমধ্যে ইয়াছিন এবং বাড়ি নেওয়ার পর মোরসালিন মারা যায়। এভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে বলে জানান ওসি আজাদ রহমান।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ঘটনার পর থেকে রিমার ওপর নজর রেখেছিল পুলিশ। বুধবার রিমা তার স্বামীর কাছে প্রথমে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। রাতে থানায় আনার পর ১৬১ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। জবানবন্দিতে রিমা জানায়, মিষ্টির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে সন্তানদের খাইয়ে হত্যা করেছে। এই কাজে তাকে মিষ্টি দিয়ে সহায়তা করেছে সফিউল্লাহ। দুপুরে আদালতে নেওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। স্বামীর দায়ের করা মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করায় তাকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোল্লা মোহাম্মদ শাহিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সফিউল্লাহর সঙ্গে লিমার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক চলছিল। ঘটনার পর থেকে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুলিশ তা নিশ্চিত হয়। বুধবার রাতে রিমাকে পুলিশের হেফাজতে আনা হয়। দুই শিশুর মৃত্যুর পর থেকে পলাতক রয়েছে সফিউল্লাহ।