জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী মাহবুবুল আলম চাষীকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পদক প্রবর্তিত হয়। তখন ১৯৭৭ সাল, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি। ওই বছর কয়েকজন পুরস্কার পান। এর তিন বছর পর রাষ্ট্রীয় এ পুরস্কার দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, কুখ্যাত রাজাকার শর্ষিনার পীর (ছারছীনা দরবার) পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দালাল আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। জিয়ার সরকার ওই আইন বাতিলের মধ্য দিয়ে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তাকে ‘মুক্তি’ দিয়ে পুরস্কৃত করে।
দুজনকেই জিয়ার সরকারের দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ওঠেছে বিভিন্ন সময়। বিতর্কিত, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, জাতির জনককে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্তদের পুরস্কার প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগের সরকারের পক্ষে একাধিকবার দেওয়া হয়েছে। টানা তের বছর ধরে সরকারে থাকলেও ওই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। মাহবুবুল চাষী, শর্ষিনার পীরের স্বাধীনতা পদক বহাল রয়েছে। বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, এটা অপমানকর ও দু:খজনক।
বিভিন্ন সময় বিতর্কিত ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া স্বাধীনতা পুরস্কার যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার ২০১৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত কেউ পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনায় ধরা পড়লে তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়। জাতীয় পুরস্কার-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিলের সুপারিশ করে ওই বছরের ২৪ আগস্ট। ওই সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পেয়ে ফেরত আসে। এরপর উদ্যোগ আর এগিয়ে যায়নি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির মত ও পথকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সরকার তের বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। সরকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কাজ করেছে। এ সরকার মাহবুবুল আলম চাষী, শর্ষিনার পীরের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করেনি। যা অত্যন্ত দু:খজনক। এটা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এতো বড় অপমান কেন দেখতে হবে? যারা স্বাধীনতা পদক পান, তাদের জন্যও চাষী, শর্ষিনার পীরের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার না হওয়াটা অপমানকর।’
তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে শর্ষিনার পীরের মাদ্রাসায় বাঙালি নিধনে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পীর আবু জাফর সালেহ ছিলেন শান্তি কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী স্বরূপকাঠিসহ আশপাশের গ্রামে চালায় হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ লুণ্ঠন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিসেম্বর মাসেই গ্রেপ্তার হন শর্ষিনার কথিত পীরসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। এ নিয়ে ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল- ‘গণহত্যার ঘৃণ্য নায়ক শর্ষিনা পীর গ্রেপ্তার’। মুক্তিযুদ্ধে ওই ঘাতক পীরের নৃশংসতা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন পত্রিকার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থ (অষ্টম খণ্ড) এবং ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
পাঠকনন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯৬ সালে রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘১৯৭১ :ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ শিরোনামের বইয়ে স্মৃতিকথায় শর্ষিনার পীরের একাত্তরের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ওই পীরের মুক্তিযুদ্ধকালীন বর্বর কাণ্ডের কথা তুলে ধরেন বিভিন্ন সময়।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পুরস্কার হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় পদক। ‘পল্লি উন্নয়নে’ অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে চাষীকে, ‘শিক্ষায় অবদানের’ জন্য শর্ষিনার পীরকে ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় জিয়ার সামরিক সরকার।