চাঁদাবাজদের নতুন কৌশল কী বঙ্গবন্ধুর নামে বই প্রকাশ?

হাসান শান্তনু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর অনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল বদলেছে। মন্ত্রিসভার সদস্য, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি করার কৌশল বিতর্কিত হয়ে পড়ায় তারা নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখে তারা সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ছে। ‘সরকারপন্থি’ পরিচয়ে সচিবালয়ে আমলাদের সঙ্গে দহরমমহরম সম্পর্ক গড়ে ওঠছে তাদের। চালিয়ে যাচ্ছে তদ্বিরবাজিসহ নানা অপকর্ম।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া একুশের বইমেলাসহ গত তিন-চার বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নামে বাজারে এসেছে প্রায় ১৪ শত বই। অধিকাংশ বই মানহীন। শুদ্ধ করে বাংলা ভাষা লিখতে জানেন না, এমন লোকেরও রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একাধিক বই আছে বাজারে। মানহীন প্রকাশনী থেকে বাজারে আসা এসব বই অশুদ্ধ বানানে ভরা। বাক্যেও আছে অসংগতি।

কথিত ‘লেখক’ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কী বলতে চেয়েছেন, তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হওয়ার জো নেই। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বইয়ের অংশ চুরি, পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যের নিবন্ধ অনুমতি ছাড়া নিজের নামে ছেপে বই হিসেবে বাজারে আনছেন রাতারাতি গজিয়ে ওঠা লেখকরা।

গবেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস সম্পর্কে একটা সময়ে দেশে আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন আর সেই অবস্থা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ইতিহাস সঠিকভাবে জানতে পারে, সেজন্য তাঁর অবদান ও ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে সৃজনশীল আরো লেখালেখির দরকার। মননশীল বই আরো বেশি বাজারে থাকা দরকার। কিন্তু অশুভ উদ্দেশ্যে আজেবাজে বই প্রকাশের যে হিড়িক পড়েছে, সেটা সমর্থনযোগ্য নয়।

অনুসন্ধান বলছে, এসব বইয়ের লেখকের আবার বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে সংগঠন আছে। চটকদার নামের এসব সংগঠনকে কোনোভাবে স্বীকৃতি দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অবৈধ ও ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের মধ্যে অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক।

কারো কারো বিরুদ্ধে কর্মসূচির নামে চাঁদাবাজির পাশাপাশি দরপত্রবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশ এলাকার বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ আছে।

কোনো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতার নাম ছাপিয়ে দাবি করা হচ্ছে চাঁদা। সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কোনো নেতার নাম জুড়ে দিয়ে সহজে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ দলের শীর্ষপদের নেতা এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও বিতর্কের কবলে পড়ে। এরপর আড়ালে চলে যান বেশ কয়েকটি সংগঠনের মালিক। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে ভুলে ভরা বই লিখে সামনে আসেন তারা। ওই বই বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে দেখিয়ে ও নিজেকে ‘সরকারপন্থি’ দাবি করে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে।

জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু কর্নারের’ জন্য আটটি বই কেনার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তালিকায় থাকা বইগুলোর মধ্যে তিনটি নিয়ে ‘জালিয়াতি’র অভিযোগ ওঠে বইগুলো প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত দুটি সংস্থার বিরুদ্ধে। গোপনে প্রকাশকের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে কপিরাইট করে নিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে জার্নি মাল্টিমিডিয়া ও স্বাধীকা পাবলিশার্স।

রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের কারাগারে থাকার সময়কাল নিয়ে লেখা ‘৩০৫৩ দিন’ শিরোনামের বইটি কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করলেও বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য যে বই সরবরাহ করা হয়, সেখানে সম্পাদক, প্রকাশক হিসেবে অন্যজনের নাম উল্লেখ ছিল।

এর বাইরে স্বাধীকা প্রকাশনীর ‘অমর শেখ রাসেল’ বইটি নিয়েও চুরির অভিযোগ ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয়গুলো তদন্তের জন্য উপকমিটি গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় দেড়শ কোটি টাকার বই কেনার পরিকল্পনা করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তখন সিদ্ধান্ত হয়, একজন লেখকের একটি করে বই ৬৫ হাজার কপি করে কিনে স্কুলে বিতরণ করা হবে।

তখন বই, বা লেখকের যে তালিকা করা হয়, তাতে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন দেশের সুপরিচিত লেখক, সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা। ২০২০ সালের ২৪ জুন দেশের ১৫ লেখক এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, সরকারের বই কেনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা মানা হচ্ছে না। দেশের অনেক লেখক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানসম্মত বই লিখেছেন।

কেনার আগে এসব বই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আনা দরকার। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়া অন্যের লেখা চুরি করে ছাপানো একজনের তিনটিসহ আটটি বই কেনার কথা বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর নামে অস্বাভাবিক হারে বইয়ের প্রকাশনা বেড়েছে। তাঁকে নিয়ে বই লেখা হতেই পারে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শসহ জীবনের বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের বিষয়ে গবেষণাধর্মী বইয়ের অভাব রয়েছে। স্তুতিবন্দনার মানহীন বই থেকে অনেক সময় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাঠকের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে।

তবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে দেশে এখন গবেষণা হচ্ছে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ারে’ দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকরা গবেষণা করছেন।

ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) বঙ্গবন্ধু চেয়ারের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে কাজ করছি। একটি বইয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। বইটির ভাষা ইংরেজি। বইটি হবে বিশ্লেষণমূলক। বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত আমি আরো কাজ করেছি। কিছু বই বেরিয়েছে, সামনেও আরো বই প্রকাশ হবে। আশা করছি, লেখাগুলো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন আলোর সন্ধান দেবে।’

শেয়ার করুন