ঢাকায় ইসকন মন্দিরে যা ঘটেছে, ভারতীয় প্রচারমাধ্যম যা বলছে

হাসান শান্তনু

পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ইসকন মন্দিরে একদল ‘দুস্কৃতকারী’ হামলা চালিয়ে সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলার ঘটনায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ‘সরব’। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা, সংবাদ পোর্টাল ও টিভি চ্যানেল ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। তবে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন ‘অর্ধশত’ বলে অভিযোগ ওঠেছে। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে দায়িত্বশীল এসব সংবাদমাধ্যম কীভাবে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ, প্রচার করছে- তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে।

মত ও পথের পক্ষে অনুসন্ধানে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের সব দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রতিবেদন নেই। সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাদের সম্পত্তি দখলের ঘটনার সংবাদ ঢাকার কয়েকটি প্রচারমাধ্যম এড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। ঢাকার সংবাদমাধ্যমে ইসকন মন্দিরে হামলা চালিয়ে দেয়াল ভেঙে ফেলার ঘটনা অনুপস্থিত থাকায় পশ্চিমবঙ্গের পাঠক, দর্শকদের পক্ষে মূল ঘটনা জানা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভার্চুয়াল মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

universel cardiac hospital

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফেসবুক, টুইটারে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ‘উস্কানিমূলক’ কথাবার্তা বলছেন। আজকাল পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম- ‘বাংলাদেশে ফের আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা! ঢাকার ইসকন রাধাকান্ত মন্দিরে ভাঙচুর-লুঠপাট’। এতে বলা হয়- ‘বাংলাদেশে ফের হিন্দুদের ওপর হামলা! দোলের আগের দিন ঢাকা শহরের ওয়ারির ২২২ লালমোহন সাহা স্ট্রিটে অবস্থিত ইসকন রাধাকান্ত মন্দিরে ভাঙচুর, লুঠপাট।’

আজ শনিবার দুপুরে আজকাল আরেকটি প্রতিবেদন প্রচার করে অনলাইন সংস্করণে। ‘ঢাকায় ইসকন রাধাকান্ত মন্দিরে ‘হামলা‌, আসল ঘটনা কি তাই?‌ প্রশ্ন উঠছে’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনা জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে।

আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর টিভি চ্যানেল এবিপি আনন্দের প্রচারিত প্রতিবেদনটি সাজায় সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। এর শিরোনাম- ‘প্রার্থনা চলাকালীন হামলা ঢাকার ইসকন মন্দিরে, ২০০ জন মিলে তাণ্ডব, আহত বেশ কয়েকজন।’ এতে বলা হয়, ‘হোলির দিনই বাংলাদেশে ইসকনের রাধাকান্ত মন্দিরে হামলার অভিযোগ। মন্দিরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ সামনে এসেছে। প্রায় ২০০ জনের ভিড় মন্দিরে হামলা চালায় বলে জানিয়েছেন ইসকন কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে দিল্লি। বংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে ভারতীয় হাইকমিশন।’

এতে দাবি করা হয়, ‘পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। হামলাকারীদের মন্দির চত্বর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যে জমির উপর মন্দিরটি অবস্থিত, সেটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝামেলা চলছে। সম্প্রতি আদালতের রায় মামলাকারীর পক্ষে যায়। এরপর থেকে ওই জমির উপর নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল এতো দিন। কিন্তু বৃহস্পতিবার আচমকাই ঝামেলা বাধে।’

পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন শিরোনাম করে- ‘ফের মৌলবাদীদের হামলার নিশানায় ঢাকার ইসকন মন্দির, চলল মারধর, লুটপাট’। এতে বলা হয়- ‘ফের বাংলাদেশে আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা। আবারও আক্রমণের নিশানায় ঢাকার ইসকন মন্দির। বৃহস্পতিবার রাতের দিকে ঢাকার রাধাকান্ত মন্দিরে আচমকাই হামলা হয়। মন্দিরের পুরোহিতদেরকে মারধর, চলে লুটপাট। আক্রান্ত প্রায় শ দুয়েক। অভিযোগ, হাজি শফিউল্লা নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিশাল দলবল মন্দিরের উপর হামলা চলে। তদন্তে নেমেছে পুলিশ।’

‘জি নিউজ’ টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদনের শিরোনাম- ‘দোলের আগের রাতে ঢাকার ইসকন মন্দিরে শতাধিক দুষ্কৃতির হামলা, ভাঙচুর-লুটের অভিযোগ’। এতে বলা হয়- ‘দোল উৎসবের ঠিক আগের রাতে, অন্ধকারে বাংলাদেশের ঢাকায় ইসকন রাধাকান্ত মন্দিরে হামলা। ভাঙচুরের অভিযোগ। প্রায় দেড়শো উন্মত্ত জনতা এসে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। ঘটনার বিরোধিতায় সরব হয়েছে ইসকনের কলকাতা শাখা।’

শনিবার সকাল সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ওয়ারী এলাকায় লালমোহন সাহা স্ট্রিটে সাড়ে ১৬ কাঠা জায়গা নিয়ে অবস্থিত এ মন্দির। এটি প্রায় দু’শো বছরের পুরোনো মন্দির বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। মূল মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত পুরোনো দেয়ালঘেরা একটি অংশে ভাঙচুর করা হয় বৃহস্পতিবার রাতে। দেয়ালের ভেতরের দিকে কোনো ব্যবহার উপযোগী আসবাবপত্র নেই। পুরোনো টিন, জানালার অংশ বিশেষসহ বিভিন্ন অব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে আছে।

মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক রুপানুগা গৌড় দাস অভিযোগ করে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি নিয়ে স্থানীয় হাজি শফিউল্লাহ, তাঁর ছেলে ইসরাফ সুফি মন্দিরের বাম পাশের অংশে হামলা চালায়। হামলায় মন্দিরের দুজন আহত হন। হামলায় আসবাবপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যে জায়গায় হামলা করা হয়েছে, সেটা মন্দিরের অংশ।’

এ ঘটনায় পর থেকে মন্দিরের সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়। শুক্রবার দুপুরে ডিএমপি ওয়ারি বিভাগের উপ-কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আলো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘এর আগে এ জমি নিয়ে তিনটি মামলা হয়েছে। সেগুলো আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। এখনো রিট করার সুযোগ আছে। তাই শফিউল্লাহ চাইলেই ইচ্ছেমতো এ জায়গা দখলের জন্য ভাঙচুর করতে পারেন না। এরই মধ্যে এ বিষয়ে একটা মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে শফিউল্লাহ, তাঁর ছেলেকে আসামি করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একটি দল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মন্দিরটির সীমানা প্রাচীরের একটি অংশ ভাঙা ছাড়া মূর্তি নেওয়া বা লুটপাটের কোনো তথ্য পায়নি। পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বিষয়টি মত ও পথকে নিশ্চিত করেন।

শেয়ার করুন