মোদির প্রশংসা কুড়ানো সিনেমা ঘিরে ভারতজুড়ে উত্তেজনা বাড়ছে কেন?

হাসান শান্তনু

বলিউডের ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর মতে, ‘এমন সিনেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে পারেন।’ উল্টো সুর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়সহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, শীর্ষ রাজনীতিক ও সরকারবিরোধি রাজনৈতিক দলের।

কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের আবেগ, দুঃখ, জন্মভিটা থেকে নির্বাসিত হওয়ার ঘটনা ভিত্তি করে নির্মিত এ সিনেমার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এর মাধ্যমে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করছে বলে তাদের অভিযোগ। রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছে। সিনেমাটিকে কেন্দ্র করে ‘ভারতীয় সমাজ হিন্দু-মুসলমান দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার’ আশঙ্কা প্রকাশ করেন দেশটির বিশিষ্টজনরা।

গত ১১ মার্চ মুক্তি পাওয়া এ সিনেমা দেখতে বারণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছত্তিসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাও চুপ থাকতে পারেননি। তাঁদের অভিযোগ- এ সিনেমার কাহিনি ‘অর্ধসত্য’। এ সিনেমার প্রচারে বিজেপির নেতৃত্বের কেন্দ্রীয়সহ দলটির বিভিন্ন রাজ্য শাসিত সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে।

তাদের বাড়তি আগ্রহ-উদ্দীপনা সবার চোখে পড়ছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছে বলে অভিযোগ করছে বিরোধিদলগুলো। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, বিহার, গোয়া, ত্রিপুরা, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাত, উত্তরাখণ্ডে এ সিনেমাকে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে পুলিশকর্মীদের সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দিতে বিশেষ ছুটির সংস্থান করা হয়েছে।

আসাম রাজ্য সরকার আরো এক পা এগিয়ে ঘোষণা করে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ছবি দেখতে গেলে অর্ধদিবস ছুটি পাবেন। তবে বিহারের এনডিএ জোটের শরিক নেতা, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঝির অভিযোগ, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস নির্মাতাদের সঙ্গে ইসলামি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের যোগ থাকতে পারে। সিনেমাটির পেছনে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। এ ছবির উদ্দেশ্য হতে পারে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মনে ভয় জাগানো, যাতে তারা আর পিতৃভূমিতে কখনো ফিরে না যান।’

বলিউডের প্রখ্যাত নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। ছবিটির পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি নিয়ে আলোচনায় উত্তাল দর্শকমহল। অবিরাম চর্চা, বিতর্কের মধ্যেই ছবির পরিচালক অগ্নিহোত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কোনো কোনো মহল। তাঁর জন্য ‘ওয়াই ক্যাটাগরির’ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তেমনই দাবি করা হয়েছে।

১৯৯০ সাল নাগাদ জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত হন কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতরা। ওই বছরের ১৯ জানুয়ারি রাতে হাজারো হিন্দু পণ্ডিত প্রায় এক কাপড়ে ভ্যালি, বা উপত্যকায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ধারণা করা হয়, এরপর কয়েক লাখ হিন্দু পণ্ডিত সেখান থেকে ভিটেছাড়া হন।

গত তিন দশক ধরে ভারতের নানা প্রান্তে তারা একরকম শরণার্থীর জীবনযাপন করছেন। নির্মম সেই ঘটনা পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। এতে অভিনয় করেন- অনুপম খের, মিঠুন চক্রবর্তী, দর্শন কুমার, পল্লবী যোশি প্রমুখ। ইতোমধ্যে এ সিনেমা ১০০ কোটির ক্লাবের সদস্য।

ভারত-শাসিত কাশ্মীর থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের নির্বাসনের বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক চর্চা চলমান থাকলেও তাদের মাতৃভিটায় ফেরানোর প্রকৃত উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার। ২০২০ সালে নির্বাসনের ত্রিশ বছর পূর্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা আওয়াজ তুলেন ‘হাম আয়েঙ্গে আপনা ওয়াতন’ (নিজেদের মুলুকে আমরা ঠিক ফিরব)।

২০১৯ সালের আগস্টে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপের পর সরকার দাবি করে, সেখানে পণ্ডিতদের ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে। তবে বাস্তবতা এখনো ভিন্ন। অধুনালুপ্ত রাজ্য বিধানসভায় অনেকবার আলোচনাও হয়েছে তাদেরকে কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনার।

কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিলের সময় সংসদে দেশটির তখনকার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, ‘পণ্ডিত ও সুফিরা কাশ্মীরের অংশ!’ সেখানকার রাজনীতিবিদদের যতোই সহানুভূতি থাক, কাশ্মীরের পরিবেশই এমন ছিল যে, হিন্দু পণ্ডিতরা সেখানে ফিরে গিয়ে আবার বসত করার বিষয়ে নিরাপদ বোধ করেননি। তবে ৩২ বছর পরও তাদের ঘরে ফেরার সঙ্কল্পে চিড় ধরেনি।

১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি রাতে সশস্ত্র, উগ্র মুসলমানরা চারদিক থেকে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির মাধ্যমে হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, হামলা চালান। এ সময় তারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ আর ‘ভারতীয় কুকুররা ফিরে যাও’ স্লোগান দেন।

মসজিদ থেকে হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে উগ্ররা দলে দলে গলি-মহল্লার চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আশির দশকের শেষদিক থেকে ভারত শাসিত কাশ্মীরে উগ্রপন্থি কার্যকলাপ শুরু হয় ‘স্বাধীনতার’ দাবিতে। তখন থেকে হিন্দু পরিবারগুলো নিশানা। কাউকে হুমকি দেওয়া হয়, কাউকে প্রাণে মেরে ফেলা হয়।

শেয়ার করুন