ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দুর্নীতির ১০ উৎস চিহ্নিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০২০-২০২১ সালের দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারি ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে বিতর্কিত জমি রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এবং জমির প্রকৃত বিনিময় মূল্য কম দেখিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশনে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। এতে জমির দাতা-গ্রহীতার সঙ্গে দলিল লেখক ও সাবরেজিস্ট্রারদের যোগসাজশ থাকে।

সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতির উৎস নিয়ে ২০২০-২০২১ সালের দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশন এসব তথ্য প্রকাশ করে।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ গত রোববার প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

ওই প্রতিবেদনে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস ছাড়াও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির ৫৪টি উৎস চিহ্নিত করে দুদক। একই সঙ্গে সরকারের এ চারটি দপ্তরের দুর্নীতি বন্ধে ৭১টি সুপারিশ করা হয়।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিতর্কিত জমি রেজিস্ট্রেশন বন্ধে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ‘রেকর্ড অব রাইটস’ এবং তা পরীক্ষা করে রেজিস্ট্রেশন করা হলে বিতর্কিত জমি রেজিস্ট্রেশন কমে যেত। তাতে দুর্নীতিও কমে যেত। এ ছাড়া দলিল রেজিস্ট্রির সময় নেওয়া পে–অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট ও চেক নির্ধারিত সময়ে জমা করা হয় না। ফলে অনেক পে–অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট ও চেক খোয়া যাচ্ছে এবং পরে জালিয়াতির মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রেজিস্ট্রেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী ক্যাশ ট্রান্সফার রিপোর্ট (সিটিআর) নিয়মিতভাবে ব্যাংকের সঙ্গে মিলিয়ে সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে বিপুলসংখ্যক নকলনবিশ থাকলেও প্রতিদিন যে পরিমাণ দলিল রেজিস্ট্রি হয়, তা ভলিউমে কপি করা হয় না। ২০১৪ সালের দলিলও বালাম বইতে কপি করা হয়নি। ফলে সার্টিফায়েড দলিলের কপি পেতে সেবাগ্রহীতারা দালালের শরণাপন্ন হন এবং দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য তাঁদের উৎকোচ দিতে বাধ্য হন।

ঔষধ প্রশাসনের কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়, সেটি তুলে ধরা হয়েছে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, নতুন ফার্মাসিউটিক্যালস ইউনিট স্থাপন, ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধ আমদানি ও প্রস্তুতকরণ, মোড়ক প্রস্তুত ও ব্যবহারে দুর্নীতি হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উপহার ও বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব দেয়। অসাধু ডাক্তারদের প্রভাবিত করে নিম্নমানের ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ রোগীদের ধরিয়ে দেয় তারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নমানের ওষুধের লাইসেন্সপ্রাপ্তির বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনেকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে জনশ্রুতি আছে। এ জন্য লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন, ফি গ্রহণ ও অনুমোদন ব্যবস্থা চালু এবং মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারের পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করেছে দুদক। একই সঙ্গে নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুত রুখতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওষুধের গুণমান পরীক্ষা এবং ডাক্তারদের উপঢৌকন দেওয়ার বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বিআরটিএর দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, যানবাহন যথাযথ পরীক্ষা করে রেজিস্ট্রেশন করার বিধান থাকলেও অনেক সময় যানবাহন না দেখে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদনকারীদের পরীক্ষার তারিখ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিলম্বিত করা হয়, যাতে আবেদনকারীরা দালালের খপ্পরে পড়েন বা দালাল ধরতে বাধ্য হন। তা ছাড়া টাকার বিনিময়েও লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীদের পরীক্ষায় পাস দেখিয়ে দেওয়া হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও বায়োমেট্রিক গ্রহণের পর সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে লাইসেন্স সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সেক্টরে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগ, মৎস্য রপ্তানির সময় সার্টিফিকেট প্রদান ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেও দুর্নীতি হয়। এ ছাড়া স্থাপনা নির্মাণের সময় ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য প্রসেসিং ফ্যাক্টরি, মৎস্যচাষিদের ও সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের শিপিং লাইসেন্স প্রদানে বিভিন্ন রকমের অনিয়ম হয়। এসব দুর্নীতি রোধে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে দুদক।

দুদক বলছে, দুর্নীতি দমনে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা প্রতিরোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করে তারা। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৭ (ঙ) ধারার আলোকে এই সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতি প্রতিরোধে তাঁদের সুপারিশগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী আমলে নেওয়া হয় না। বিষয়টি তাঁরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জানিয়েছেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের। এটা দেখার প্রশাসনিক এখতিয়ার দুদকের নেই। আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অনুরোধ করেছি, এ সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিশ্চিত করতে তারা যেন কাঠামো তৈরি করে দেয়। কারণ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে।’

সংবাদ সম্মেলনে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার (অনুসন্ধান) জহিরুল হক, মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান ও এ কে এম সোহেল, পরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন, সৈয়দ ইকবাল হোসেন এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেকসহ কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন