চারদিকে যা ঘটছে তা দেখে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন জেগেছে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া পুরো সরকার বা বাংলাদেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ কি এখন ঘুমের ঘোরে রয়েছে? যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা স্বীকার করবেন একজন শেখ হাসিনা ঘুমের ঘোরে নেই। তবে তাঁকে কি দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানতে দেওয়া হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানানো যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা কি প্রকৃত অর্থে তাঁদের সেই দায়িত্ব পালন করছেন? এককথায় এর উত্তর, ‘না’। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে না।
তবে তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা। প্রধানমন্ত্রীকে কিভাবে জনবিচ্ছিন্ন করা যায় এখন সেই প্রতিযোগিতা চলছে। এই কর্মে লিপ্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তাঁরা বহুলাংশে সফল। অভিযোগ আছে, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ। দল বা সরকারে যাঁরা প্রকৃত অর্থে প্রধানমন্ত্রীর শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁদের বেশ সূক্ষ্মভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। এ যেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্ববর্তী সময়ের একটি রিহার্সাল চলছে। আশা করি, আমার মন্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনঃক্ষুণ্ন হবেন না। হলে ক্ষমাপ্রার্থী।
দেশে এখন বিরোধী দলের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। কিছুদিন বিএনপি তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে বেশ হৈচৈ করেছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা প্রমাণ করেছেন, বিদেশে না গিয়েও এ দেশে অনেক কঠিন রোগের চিকিৎসা সম্ভব। কয়েক দিন আগে একজন দক্ষ চিকিৎসক একজন রোগীর দেহে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড লাগিয়ে দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
বিএনপি ছাড়াও দেশে আরো বেশ কিছু প্যাডসর্বস্ব রাজনৈতিক দল আছে, যাদের রাজনৈতিক মেয়াদ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাদের মাঠ গরম করার সক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের বাম দলগুলো দেশের রাজনীতিতে বেশ গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু বাম দলগুলো এখনো পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। তার একটি বড় উদাহরণ দেশে শেখ হাসিনা সরকারের কোনো ভালো কাজকে প্রশংসা করলে এখনো কোনো কোনো বাম দলের বড় নেতার সদস্য পদও স্থগিত করা হয়। কোনো অবস্থায়ই শেখ হাসিনার কোনো কাজের প্রশংসা করা যাবে না। তারা ভুলে গেছে এই দেশে তাদের নিজ নামে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একসময় যে বাম দলগুলো ভারতের একাধিক রাজ্য শাসন করত, তারা এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে। সেখানকার মানুষ বলে রামপন্থী আর বামপন্থী এক হলে এমনটাই হওয়ার কথা।
দেশের রাজনীতিতে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমূল্য এক কঠিন বাস্তবতা। দুই বছর করোনাকাল অতিক্রম করার কারণে অনেক মানুষ তাদের আয়ের উৎস হারিয়েছে। দেশে এই সময়ে দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর কমিয়েছে। তাতেও প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে।
তিনি এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন দেশের এক কোটি মানুষকে টিসিবির পণ্য কেনার জন্য রেশন কার্ড দেওয়া হবে। এই কার্ড দেওয়া শুরু হলে তখন আবার জানা যাবে নানা অনিয়মের খবর। কিন্তু রাতের টিভির টক শোগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতারা দ্রব্যমূল্য নিয়ে যেসব কথা বলেন তাতে মনে হয় বাজারে যা হচ্ছে তা স্বাভাবিক। আর যখন সরকারি কর্মকর্তারা কথা বলেন তখন মনে হয় আর কয়েক দিন পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বাঙালির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অন্যতম হচ্ছে সয়াবিন তেল।
ছাত্রলীগের সভাপতিসহ একাধিক ব্যক্তি হিসাব করে দেখিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হওয়া সয়াবিন তেল ঢাকার বাজারে লিটারপ্রতি ১২৫ টাকায় বিক্রয় হলেও ব্যবসায়ীদের লিটারপ্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকা লাভ হয়। সরকারি কর্মকর্তা বলি আর আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা বলি, সবার একটি অভিন্ন বাক্য—‘এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী এই অপকর্মগুলো করছেন। ’ তাহলে দেশে এক ধরনের সাধু ব্যবসায়ীও আছেন। তাঁরা কোথায় অবস্থান করেন তা জানলে সাধারণ মানুষ খুশি হতো। এসব নেতা বা কমকর্তারা বলে থাকেন সামনের রমজানের আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে। এটা কোন জাদুমন্ত্র বলে হবে তা তো মানুষ জানতে চায়।
গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ১৯ থেকে ১২ জন আমদানিকারকের হাতে। তাঁদের নামও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই সব সময় সরকারঘনিষ্ঠ। যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। তাঁদের বেশির ভাগই দেশে থাকেন না। কেউ থাকেন সিঙ্গাপুরে, কেউ বা কুয়ালালামপুরে। এতে দেশে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। নিয়মিত তাঁদের ব্যবসার লভ্যাংশের হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। কানাডার বেগমপাড়ার কথা না-ই বা উল্লেখ করলাম।
আমাকে নিয়মিত ঢাকার বেড়ি বাঁধের রাস্তা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। মোহাম্মদপুর থেকে যে সড়কটি বেড়ি বাঁধে উঠেছে সেখানে একদল চাঁদাবাজ হাতে লাঠি নিয়ে নিয়মিত বাস-ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করে স্থানীয় বড় ভাইয়ের নামে। লেগে যায় ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম। তা দেখার কেউ নেই। এটি মাত্র একটি উদাহরণ। এই যে ঢাকা বা অন্যান্য শহরে ফুটপাত দখল করে যাঁরা নানা কিসিমের ব্যবসা করেন তাঁদের কাছ থেকে কতজন আর কী হারে চাঁদা আদায় করেন তা কি কারো অজানা। আমার এক পরিচিতজন গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ধানমণ্ডির এক শাখা সড়কে একটি ছোট চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। বছর না ঘুরতেই তিনি দোকান গুটিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন, কারণ তাঁর দেয় চাঁদা প্রতি মাসে জ্যামিতিক হারে বাড়ছিল। বেচারা দেশের বাড়িতে এখন লঞ্চঘাটে কুলির কাজ করেন।
লক্ষ্মীপুরের এক নির্বাচিত চেয়ারম্যান সম্প্রতি তাঁর এলাকায় ফতোয়া জারি করেছেন কোনো মেয়ে বোরকা না পরে স্কুলে যেতে পারবে না, আর স্কুলে যাওয়ার সময় মোবাইল ফোন নেওয়া যাবে না। কোথাও যদি উচ্চৈঃস্বরে গান-বাজনা হয়, তাহলে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। তিনি কি দেশের ভেতর আরেকটি দেশ চালু করলেন? দেশে আইন-কানুন নেই? এসব দেখার জন্য তো সরকারের স্থানীয় প্রশাসন আছে। তারা কোথায়?
কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে নানা অপ্রীতিকর বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। সম্ভবত ২০২০ সালের কথা। একুশে পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। একজন আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন এই ধরনের পদক পেতে কত টাকা চাঁদা দিতে হয়? আমি তো অবাক। বলে কী? রাষ্ট্রীয় পদক পেতে চাঁদা? তালিকা দেখে ভদ্রলোকের কথায় অবাক হলাম না। আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ এহজনকে একজনের পদক পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি অকপটে স্বীকার করলেন এটি ‘কোটায়’ পেয়েছেন, কারণ যিনি পদক পেয়েছেন তিনি ক্ষমতার একজন ঘনিষ্ঠ মানুষের স্বজন। প্রায় রাতে তাঁকে টেলিভিশনে জনগণকে নসিহত করতে দেখা যায়।
কয়েক দিন আগে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশিত হলো। এ বছর সাহিত্যে এই পদক দেওয়া হয়েছে কোনো এক আমির হামজাকে, যিনি জীবনে তিনটি বই লিখেছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তিনি খুনের মামলার আসামিও ছিলেন। তবে আমির হামজার বড় পরিচয় তিনি একজন উপসচিব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার পিতা। আর কী চাই!
দেশটি যে এক শ্রেণির ধান্দাবাজ আমলার খপ্পরে পড়েছে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? কিভাবে সরকারকে বিব্রত করা যায় সেই প্রচেষ্টায় তারা সবাই এখন একজোট হয়েছে। তারা অনেকাংশে সফল। নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে অবশেষে শুক্রবার আমির হামজার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
এর আগে ২০২০ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য নাম প্রকাশ করা হয়েছিল এই রকম এস এম রইস উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির, যাঁকে কেউ চিনত না। পরে এ নিয়ে চারদিকে তুমূল বিতর্ক সৃষ্টি হলে তাঁর নামও তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এতে বিব্রত হয় সরকার। সরকারের জন্য এসব বিব্রতকর পরিস্থিতি যাঁরা সৃষ্টি করেন তাঁরা তা জেনেশুনেই করেন। তাঁরা চান না শেখ হাসিনা বর্তমানে নিজে যে উচ্চতায় উঠেছেন বা দেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার বেশি তিনি বা দেশ যেন আর না ওঠে।
বলার আরো অনেক কিছু ছিল; কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বেশি দূর যাওয়া যাচ্ছে না। তবে এটি সত্য যে এমনটি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলো খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। ঘুমের ঘোর কাটতে বেশি সময় না-ও লাগতে পারে। সময় থাকতে সাধু সাবধান। শেখ হাসিনা আর কত দিন এই দেশকে একা নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াবেন?
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক